বিলুপ্তির পথে উপকূলীয় অঞ্চলের খেজুর রস

সাতক্ষীরা জেলা প্রতিনিধি

৯ জানুয়ারী, ২০২২, ২ years আগে

বিলুপ্তির পথে উপকূলীয় অঞ্চলের খেজুর রস
ফাইল ছবি | পত্রিকা একাত্তর

শীতের শুরুতে সকালে আবছা আলোয় প্রকৃতি থাকে ভেজা, এরই মধ্যে এক চুমুক খেজুরের রস প্রাণকে করে তাজা, ঋতুবৈচিত্যের পালাক্রমে চলছে শীত। নানা রকম খাবার, ফুল-ফল, সবজি ও পিঠাপুলির আমেজ নিয়ে হাজির হয় শীতকাল, শীতকালীন খাদ্য তালিকায় প্রথমেই আসে অতিপ্রিয় সুস্বাদু খেজুরের রস। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য সাতক্ষীরা জেলার উপকূলীয় উপজেলার শ্যামনগরের গাবুরা,রমজাননগর, পদ্মপুকুর, বুড়িগোয়ালিনী, মুন্সিগঞ্জে, কৈখালীতে গাছ অভাবে সেই মুখোরোচক খেজুর রস এখন বিলুপ্তর পথে। রস না পাওয়ার জন্য একদিকে প্রাকৃতিক দূর্যোগ এবং অন্যদিকে গাছির অভাব ও ইটভাটার আগ্রসনকে দায়ী করছেন উপকূলবাসী।

উপকূলীয় এলাকাবাসী জানায়, এক সময় কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকালটা যেনও খেজুরের রস ছাড়া জমতো না,শীত ও খেজুরের রস যেনও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকতো। সকালবেলার ঠান্ডা, মিষ্টি খেজুরের রস যেনও অমৃত।

বাংলা আশ্বিন মাস থেকে সাধারণত রস সংগ্রহ শুরু হয়। তবে পৌষ ও মাঘ মাসে সবচেয়ে বেশি রস পাওয়া যায়, কারণ এই দুই মাসে শীতের প্রকোপ থাকে সবচেয়ে বেশি,আবহাওয়া যত ঠান্ডা থাকে রসও তত বেশি পাওয়া যায়। ধীরে ধীরে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে আর রসও কমতে থাকে,একসময় শীতের সকালে পূর্ব আকাশে সূর্যি দেখার আগেই গাছিরা গাছ থেকে রসের হাড়ি নামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়তো। রস নিয়ে পাড়ি জমাতো দূর-দূরান্তের হাট-বাজারে। আগের দিনে রস কিনতে অনেক লোকের সমাগম দেখা মিলতো রসের হাঁটে। কুয়াশা ঘেরা সকালে গাছিদের কাঁধে করে হাঁড়ি ভরা রস নিয়ে যাওয়ার মনোমুগ্ধকর দৃশ্য আমাদের মনে হতো গ্রামীন বাংলাদেশ ছাড়া আর পৃথিবীর কোথাও হয়তো দেখাই যায় না,মনে করিয়ে দেয় সেই রং তুলিতে আঁকা শিল্পীর এক মনোরম চিত্রকর্মের কথা। কিন্তু সেসব দৃশ্য এখন আর দেখা যায় না।

কৈখালী গ্রামের একজন বৃদ্ধা বলেন, শীতের সকালে গাছ থেকে নামানো কাঁচা রসের স্বাদ যেমন বর্ণনা করা সম্ভব নয়, তেমনি জ্বাল করা রসের তৈরি বিভিন্ন খাবারের স্বাদ ও চাহিদাও অনেক। কুয়াশামাখা সকালবেলায় রসের তৈরি পায়েসের গন্ধে সুভাস ছড়িয়ে পড়ে চারিদিক। সেই মিষ্টি গন্ধে মানুষের সাথে যেন পিপড়া-মাছিরও ঘুম হারাম হয়ে যেতো একসময়।

রসের অভাবে সেই সব উৎসব এখন আর নেই,তবে খেজুরের রসের পাটালি ও গুড়েরও বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে বাংলার ঘরে ঘরে,এই গুড় দিয়ে হরেক রকম পিঠা বানায় গ্রামের বধূরা,ভাপা, সিদ্ধপুলি, মালপোয়া, লালুয়া, রসের চিতইয়ের মতো বহুরকম পিঠা,আর এই পিঠা বানানো ঘিরে শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সবার বসে থাকার দৃশ্য বাংলার এক পুরোনো সংস্কৃতিরই অংশ। মনে হয় শীত যত বেশি, তাদের পিঠা খাওয়ার তৃপ্তি, আনন্দও তত বেশি। এরূপ দৃশ্যকে কবি সুফিয়া কামাল চিত্রায়িত করে বলেছেন- পৌষ পর্বণে পিঠে খেতে বসে খুশিতে বিষম খেয়ে, বড় উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি খেয়ে,বাংলাদেশের খেজুর গাছের প্রধান আকর্ষণ খেজুরের রস,উপজেলার অনেক গাছিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রাকৃতিক দূর্যোগের ও ইটভাটার প্রভাবের ফলে গত কয়েক বছরে এ দেশ থেকে অনেক খেজুরের গাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

তাহারা আরো জানান, একটি খেজুর গাছের রস দেয়ার মতো উপযুক্ত হতে ১০ থেকে ১২ বছর সময় লাগে এবং ৩০ বছর পর্যন্ত রস দিয়ে থাকে,একটি পূর্ণ বয়স্ক গাছ থেকে দৈনিক ১০-১২ লিটার রস পাওয়া যায়,তবে খেজুর রসের পরিমাণ গাছ ছিলার কৌশল ও যত্নের উপর অনেকটা নির্ভর করে।

উপজেলার রমজাননগর,মুন্সিগঞ্জ, কৈখালী গ্রামের কয়েকজন গাছিরা জানান, তাদের কাছে প্রায় সময় গ্রামবাসী রস চাইলেও তাদের চাহিদা তাহারা পূরণ করতে পারেননা,কিন্তু আগের তুলনায় খেজুর গাছ একেবারে নেই বললে ও চলে বিভিন্ন দূর্যোগের কারণে রস তো দূরের কথা গাছ ও কমে গেছে, তাই উপকূলে খেজুর গাছ ও খেজুরের রস আজ বিলুপ্তির পথে।

তাহারা আরো জানান, এখন গাছিরা খেজুর রস ও গুড় বিক্রি করে তাদের সংসার চালাতে পারছে না। তাই এ ব্যবসার প্রতিও তাদের তেমন কোনো আগ্রহ নেই।

সাংবাদিক রুহুল-আমীন সুমন জানান, শুধু উপকূল নয় ইতোমধ্যে বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল থেকে গাছি আর রস দুটিই বিলুপ্ত হয়েছে,এক সময় গ্রামের প্রায় সব মানুষ শীতের সকালে বাজার করতে গিয়ে প্রথমেই সেখানে এক গ্লাস খেজুরের রস খেয়ে প্রাণটাকে ঠান্ডা করে বাজার শুরু করত, এখন গ্রামেও সেই দৃশ্য দেখা যায় না বললেই চলে। এখন সরকারি উদ্যোগে দেশের গ্রাম অঞ্চলে বেশী বেশী খেজুর গাছ রোপণ করা প্রয়োজন,তাহলে হয়তো আমাদের ছেলে মেয়েদের মাঝে সেই খেজুর রসের পিঠা উৎসব ও শীতকে ঘিরে গ্রাম বাংলা থেকে হারিয়ে যাওয়া বাঙালীর আনন্দো-উল্লাস আবারও ফিরে আসবে।

ভেটখালী ও হরিনগর বাজারের গুড় ব্যবসায়ীদের হতে জানা যায়, উপকূলীয় অঞ্চলে খেজুর রসের গুড় নেই,এ কারণে শীত এলেই অনেক পাটালি গুড় বিক্রি হচ্ছে,প্রতি কেজি গুড় ১০০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হয়। সকলকে এখন পাটালিগুড় দিয়েই শীতকালীন নানান পিঠা খেতে হয় বলে জানান তাহারা।

ভিডিও দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন

youtube
Patrika71.com
news