নড়াইল পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের দরিদ্র গ্রাহকদের বিরুদ্ধে অস্বাভাবিক জরিমানা

নড়াইল জেলা প্রতিনিধি

৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২২, ২ years আগে

নড়াইল পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের দরিদ্র গ্রাহকদের বিরুদ্ধে অস্বাভাবিক জরিমানা
ফাইল ছবি | পত্রিকা একাত্তর

নড়াইল সদরের আউড়িয়া ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর গ্রামের দিনমজুর মুরাদ মিয়া গত ২২ জানুয়ারী কাজে বাইরে গিয়েছিলেন। সন্ধ্যার দিকে বাড়িতে এসে দেখেন পল্লী বিদ্যুৎ অফিস থেকে তার মিটার খুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে বিদ্যুৎ মিটার টেম্পারিং-এর অভিযোগে তাকে ৩৭ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

দ্রুত এ টাকা পরিশোধ করতে হবে না হলে তার বিরুদ্ধে ঢাকা হাইকোর্টে মামলা এবং পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া হবে। তবে তাকে (মুরাদকে) যে নোটিশ দেওয়া হয়েছে তাতে বলা হয় ২৭ জানুয়ারী মিটার টেম্পারিংয়ের বিষয়টি অফিসে তার উপস্থিতিতে পরীক্ষা করা হবে। তার আগেই তিনি ভয়ে ২৪ তারিখ বাড়ির গরু বিক্রি করে বিদ্যুৎ অফিসে গিয়ে সেই জরিমানা পরিশোধ করেন।

পার্শ্ববর্তী ষড়াতলা গ্রামের প্রান্তিক কৃষক কাশেম মোল্যার স্ত্রী রাণু বেগম জানান, ২১ জানুয়ারী বিদ্যুৎ অফিস থেকে মিটারটি খুলে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় ৩৪ হাজার টাকা নিয়ে দু’একদিনের মধ্যে অফিসে যেতে বলা হয়। না হলে ঢাকায় মামলা করা হবে। তখন ভয়ে জমি বন্দক রেখে, সুদে টাকা নিয়ে ২৫ হাজার টাকায় মিটমাট করি। তিনি বলেন, সর্বশেষ ডিসেম্বরে বিল পরিশোধ করেছি ৩২৮টাকা। সে সময় মিটার রিডার বিল করার সময় কোনো অভিযোগ করেনি। কিন্তু হটাৎ করে জানুয়ারী মাসে এ ধরনের অভিযোগ রহস্যজনক।

ষড়াতলা গ্রামের ৭০ বছরের দরিদ্র বিধবা সবেদা বেগম বলেন, দুইটি-বাতি আর দুইটি-ফ্যান ব্যবহার করি। প্রতি মাসে বিল আসে গড়ে ২শ টাকা বিল আসে। অথচ মিটার টেম্পারিংয়ের অভিযোগ এনে তাকে জরিমানা করা হয়েছে ৫১ হাজার টাকা। অফিস থেকে বলেছে, তিন দিনের মধ্যে টাকা না দিলে তার বিরুদ্ধে ঢাকায় মামলা দেওয়া হবে। তিনি বলেন,স্বামী মারা যাওয়ার পর না খেয়ে থেকেছি কখনো কারোর জিনিস ধরিনি। আর অফিসের কর্মচারিরা আমাকে চোর বলে গালি দেয়। বলে বুড়ি বিদ্যুৎ চুরি করছিস টাকা না দিলে জেলে গিয়ে মরবি।

ষড়াতলা গ্রামের প্যারালাইজ ইসলাম সরদার জানান, গত এক বছরে তিনি ২৪শ ৭৮টাকা (মিটারের হিসাব নম্বর ৩১৮/১৮০০) বিল দিয়েছেন। কোন মাসের বিলে কোনো অসংগতি ধরা পড়েনি। কিন্তু গত জানুয়ারী মাসের ২২ তারিখে ৪৫ হাজার ৭১৮ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তিনি ডিজিএম-এর কাছে নিজের অসহায়ত্বেও কথা জানালে ধমক দিয়ে বের করে দেন এবং বলেন তুমি মরলেও আমার কিছু যায় আসেনা। এভাবে ষড়াতলা গ্রামের জলি বেগমকে ১৬ হাজার টাকা জরিমানা ধরা হয়েছে।

সবার অভিযোগে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির অসাধু কর্মচারি-কর্মকর্তা ও দালালেরা মিটার টেম্পারিং এর মিথ্যা অভিযোগ এনে মামলা, পুলিশের ভয় দেখিয়ে আমাদের সামর্থের বাইরে হাজার হাজার টাকা জরিমানা ধরছে।

জানা গেছে, গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে জানুয়ারী মাস পর্যন্ত যশোর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ নড়াইল জোনাল অফিসের ৫৭জন গ্রাহকের বিরুদ্ধে মিটার টেম্পারিং করে বিদ্যুৎ চুরির অভিযোগ আনা হয়েছে। পল্লী বিদুৎ সমিতি-২ নড়াইল জোনাল অফিসের লাইন ম্যান আরিফ হোসেন ষড়াতলা গ্রামের ৭টি দরিদ্র পল্লী বিদ্যুৎ গ্রহকদের মিটার খুলে এনে তাদের জরিমানার আওতায় আনার কথা স্বীকার করে বলেন, গ্রাহকদেও বিরুদ্ধে মিটারের সিল কাটা ও গলিয়ে ফেলার অপরাধে তাদের মিটার খোলা হয়েছে। শড়াতলা গ্রামের মোঃ রাসেল মিয়া জানান, তার এলাকায় প্রায় অর্ধশত পরিবারের মিটার টেম্পারিং করার অভিযোগ এনে মিটার খুলে নেওয়া হয়েছে। যাদেও বিরুদ্ধে টেম্পারিং করার অভিযোগ করা হয়েছে তাদেও মাসিক বিদ্যুৎ বিল ২০০/২৫০ টাকার বেশি নয়। আর এক এলাকায় এত লোকের মিটার এক সাথে কিভাবে নষ্ট বা টেম্পারিং করা হলো তা মাথায় আসছেনা।

এ ব্যাপারে আউড়িয়া ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের মেম্বর সাইফুল ইসলাম বলেন, গত ৪ দিন আগে নব নির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যানসহ কয়েক মেম্বর ও গ্রাহক ডিজিএম মহোদয়ের কাছে গিয়েছিলাম। গ্রাহকদের যে বার্ষিক বিল তাতে সর্বচ্চ ৩-৪ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে। কিন্তু এতো টাকা বিল হতে পারে না। তাছাড়া এরা সবাই গরীব মানুষ এরা সবাই ঢালাওভাবে মিটার টেম্পারিং করতে পারে তা আমাদের কাছে মনে হয়না। এখানে কোনো কুচক্রিমহল মহল কাজ করছে বলে মনে হয়। নড়াইল জজ আদালতের আইনজীবী অ্যাডঃ খন্দকার সোহেলী সুলতানা শিলী বলেন, যে কোনো অভিযোগের আগে নোটিশ করা আইনি বাধ্যবাধ্যকতা আছে। তা না করে সরাসরি এভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা আদায় করাটা বেআইনি।

যশোর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ নড়াইল জোনাল অফিসের সদ্য যোগদানকারী ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) এসএম শাহিন আহসান জানান, গ্রাহক মিটার টেম্পারিং করলে একটি তারিখ দিয়ে তাদের উপস্থিতিতে মিটার খুলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার নিয়ম রয়েছে। জরিমানার জন্য সাধারনত ৩০দিন সময় দেওয়া হয়। তবে যদি কেউ আর আগে তাদের দোষ স্বীকার করে অর্থ জরিমানা দেওয় তাহলে আমাদের সে অর্থ নিতে কোন সমস্যা নেই। তিনি গ্রাহকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা এবং তাদের সাথে দুর্বব্যবহারের কথা অস্বীকার করেন।

পত্রিকা একাত্তর/হাফিজুল নিলু

ভিডিও দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন

youtube
Patrika71.com
news