কুরবানির ঈদ : স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আমাদের করণীয়

অতিথি লেখক

৯ জুলাই, ২০২২, ১ year আগে

কুরবানির ঈদ : স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আমাদের করণীয়

রবিবার ১০ জুলাই ২০২২ ইং পালিত হতে যাচ্ছে মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহা বা কুরবানির ঈদ। কিন্তু আজ দৃইবছর যাবৎ ঈদ অন্যবারের তুলনায় নি:সন্দেহে ব্যতিক্রম। এবারে ঈদের রঙ অনেকটাই ফ্যাকাসে।

কারণ, বিশ্বজুড়ে চলছে বৈশ্বিক মহামারি করোনা সংকট। একাধিকবার বন্যার আগমন। এর সাথে যুক্ত হয়েছে দেশে কয়েকধাপে চলে আসা বন্যার্ত মানুষের কষ্টের আকুতি আর আর্তনাদ। বাংলার মানুষের জীবন কার্যত তছনছ করে দিয়েরছ আর অসংখ্য মানুষের ঘর ভেঙ্গে নিয়েছে আগত বন্যা।

কেমন যাবে আমাদের এ ঈদ!! আত্মত্যাগ ও মানবতার বার্তা নিয়ে প্রতিবছর মুসলমানের সামনে হাজির হয় এ উৎসব।মহাসমারোহে পালিত হয় বিশ্ব মুসলিমের ঐক্য ও সৌহার্দ্যপূর্ণ এ ইবাদত।ঈদ একটি আরবি শব্দ। শব্দটি খুশি, উৎসব এবং আনন্দ প্রকাশক অর্থেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। শব্দটি আরবি হলেও বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, ফার্সি এবং হিন্দিসহ প্রায় সব ভাষাতেই শব্দ ও অর্থের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই।

ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায়, জিলহজ্ব মাসের ১০ তারিখ থেকে শুরু করে ১২ই জিলহজ্ব দুপুর পর্যন্ত মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে প্রাণী জবাই করাকে ঈদুল আযহা বলা হয়।আজকের ঈদুল আযহা স্বাস্থ্য সুরক্ষা আমাদের করণীয় নিয়ে কলাম লিখেছেন জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটির প্রতিষ্ঠা বিশিষ্ট গবেষক ডা.এম এম মাজেদ....

ঈদের দিন সকালের খাবারঃ

ঈদের নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে অল্প করে সেমাই বা পায়েশ খান। অনেকেই শরবত, কোমল পানীয়, ফ্রুট জুস ইত্যাদি খাওয়া পছন্দ করেন। চেষ্টা করুন মৌসুমি ফল দিয়ে এসব জুস তৈরি করতে। কারণ এসব জুসের কোনো তুলনা নেই। তাতে মজা ও উপকার দুই-ই পাবেন। লেবুর শরবত, বাসায় বানানো ফলের রস, কিশমিশ, বাদাম, ডাবের পানি, বোরহানি ইত্যাদি খাওয়া যায়। খাওয়ার আধঘণ্টা পর দেড় থেকে দুই গ্লাস পানি খেয়ে নামাজ পড়তে যান।

ঈদের সময় খাবার খাবেন বুঝেশুনেঃ

যাঁদের বয়স কম, শারীরিক বা হজমেরও কোনো সমস্যা নেই, তাঁরা নিজের পছন্দমতো সবই খেতে পারেন, শুধু অতিরিক্ত না হলেই হলো, বিশেষ করে চর্বি-জাতীয় খাদ্য। বেশি মাংস খেলে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা বেড়ে যায়।

যাঁদের এনাল ফিশার ও পাইলস-জাতীয় রোগ আছে, তাঁদের পায়ুপথে জ্বালাপোড়া, ব্যথা ইত্যাদি বাড়তে পারে, এমনকি পায়ুপথে রক্তক্ষরণও হতে পারে। তাই প্রচুর পরিমাণে পানি, শরবত, ফলের রস, ইসবগুলের ভুসি ও অন্যান্য তরল খাবার বেশি খাবেন। পেটে গ্যাস হলে নাক্স ভূমিকা,ওষুধ খেতে পারেন। যাঁদের আইবিএস আছে, তাঁরা দুগ্ধজাত খাবার পরিহার করুন। দাওয়াতে গেলে পরিমিত খাবেন।

অতিভোজন পরিহার করার চেষ্টা করবেন। হয়তো অনেক খাওয়া-দাওয়া টেবিলে সাজানোই থাকবে, কিন্তু খেতে বসলেই যে সব খেতে হবে তা নয়। রাতের খাবার খেয়েই ঘুমিয়ে পড়বেন না। খাওয়ার অন্তত দুই ঘণ্টা পর বিছানায় যাবেন। খাবারের ফাঁকে ফাঁকে পানি খাবেন না, এতে হজম রসগুলো পাতলা হয়ে যায়। ফলে অনেক সময় হজমে অসুবিধা হয়। তাই খাওয়ার অন্তত এক ঘণ্টা পর পানি পান করুন।

ঈদের সময় চর্বি এড়িয়ে চলুন :

অতিরিক্ত চর্বি খাওয়া এমনিতেই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কোরবানির সময় এ বিষয়টি বিশেষভাবে খেয়াল রাখা উচিত। অনেক সময় দেখা যায়, আমরা রান্না সুস্বাদু হবে মনে করে মাংসে বেশ কিছু চর্বি আলাদাভাবে যোগ করি, এমন ধারণা একেবারেই ভুল। মাংসের সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণে সবজি খাওয়া যেতে পারে।

টাটকা সবজি পাকস্থলীকে সাবলীল রাখে। পরিমিতি বোধ যেখানে রসনা সংবরণ করতে পারে, সেখানে ভয়ের কিছু নেই। মাংসে তেল বা ঘিয়ের পরিমাণ কমিয়ে দিলে, ভুনা মাংসের বদলে শুকনো কাবাব করে খেলে, কোমল পানীয় ও মিষ্টি একেবারে কমিয়ে খেলে কোরবানির ঈদের সময়ও ভালোই থাকা যায়। সেই সঙ্গে হালকা ব্যায়াম বা বেশ কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে শরীর থেকে অতিরিক্ত ক্যালরি কমিয়ে নিতে পারলে আরও ভালো।

ঈদের সময়বয়স্কদের থাকতে হবে সচেতনঃ-মধ্যবয়সী এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের খাবার সম্পর্কে সচেতন থাকা আরও জরুরি। এমনকি উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তে অতিরিক্ত চর্বি ইত্যাদি না থাকা সত্ত্বেও এই বয়সের মানুষের ঈদের খাবারের ব্যাপারে বাড়তি সতর্ক থাকা দরকার। অতি ভোজনে তাঁদের পেট ভরা ভাব, অস্বস্তিকর অনুভূতি, বারবার ঢেঁকুর ওঠা এমনকি বুকে ব্যথা পর্যন্ত হতে পারে।

বেশি মাংস খেলে তা পরিপূর্ণভাবে হজম হতে সময় লাগে। ডায়াবেটিস রোগীকে অবশ্যই মিষ্টিজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। তারা বরং টক খাবারের মাধ্যমে রসনা পূরণ করতে পারেন। নেহাত মিষ্টি খেতে চাইলে চিনির বিকল্প দিয়ে তৈরি করে নেবেন। পোলাও, বিরিয়ানি কম খাবেন। গরু বা খাসির মাংস খাওয়া যাবে, পরিমাণটা অতিরিক্ত যাতে না হয় এবং চর্বি যেন কম থাকে।

ঈদের সময় উচ্চরক্তচাপ, স্ট্রোক এবং হৃদরোগীরাঃ-অতিরিক্ত গরুর মাংস খেলে স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বেড়ে যায়। শুধু গরু নয়, মহিষ, ছাগল ও খাসির মাংসে থাকে উচ্চমাত্রার প্রোটিন ও ফ্যাট, তাই অতিরিক্ত মাংস খেলে স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও কোলেস্টেরল এর মাত্রা বেড়ে যায়, বিশেষ করে যারা আগে থেকেই এসব রোগে ভুগছেন তাদের ঝুঁকি আরও বেশি।

তাই মাংস খাওয়ার সময় অবশ্যই খেয়াল রেখে পরিমিত পরিমাণে এবং চর্বি ছাড়িয়ে খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। সারা বছর তাঁরা যে ধরনের নিয়মকানুন পালন করেন খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে, কোরবানির সময়ও সেভাবে চলাই ভালো। কোরবানির মাংস একটু-আধটু খেলে শরীরের যে খুব ক্ষতি হয়ে যাবে তা নয়, তবে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। যাঁদের ওজন বেশি, তাঁদের অবশ্যই ঈদের সময় খাওয়ার ব্যাপারে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে।

ঈদের সময় কিডনি রোগীদেরঃ-

যাঁরা কিডনির সমস্যায় ভোগেন, যেমন ক্রনিক রেনাল ফেইলুর, তাঁদের প্রোটিন-জাতীয় খাদ্য কম খেতে বলা হয়। তাই মাংস খাবার ব্যাপারে আরও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কোনোক্রমেই অতিরিক্ত মাংস খাওয়া ঠিক হবে না। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সারা বছরের মতো ঈদের সময়ও একই খাবার খাওয়াই ভালো।

ঈদের মাংস সংরক্ষণঃ-কোরবানির পরে মাংস বিলিয়ে দেওয়ার পরেও দেখা যায় ঘরে অনেক মাংস জমা থাকে, তা ভালোভাবে সংরক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরি। ফ্রিজে সংরক্ষণ সম্ভব হলে ভালো। তবে গ্রামগঞ্জে এমনকি শহরে অনেকের বাসায় ফ্রিজ না থাকলে সঠিকভাবে মাংস জ্বাল দিয়ে রাখতে হবে।

এমনকি মাংস সেদ্ধ কওে শুকিয়ে শুঁটকির মতো করে অনেক দিন খাওয়া যেতে পারে। খাবার আগে খেয়াল রাখতে হবে, যেন মাংসের গুণগত মান ঠিক থাকে।পরিশেষে ঈদ আনন্দের। আর খাবারের তৃপ্তি না থাকলে এ আনন্দ যেন পূর্ণতা পায় না। তবে তা হতে হবে পরিমিত। ঈদের উৎসব আনন্দ আগেও ছিল, চলছে এবং ভবিষ্যতেও চলতেই থাকবে।

খাওয়া-দাওয়ারও উৎসব আনন্দ অতিভোজন একইভাবে চলবে। অন্তত একটা দিন হলেও সবার এমন ইচ্ছা থাকে। তারপরও সবাইকে রয়ে-সয়ে খেতে হবে। কারণ অসংযমীভাবে খাদ্যগ্রহণ করে শুধু শুধু এই করোনাকালে ডাক্তারের কাছে কিংবা হসপিটালে ছোটাছুটির আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা ভেবে দেখতে হবে। সে ক্ষেত্রে ভোগান্তি বাড়বে বই কমবে না।

ঈদ এবং ঈদ-পরবর্তী সময়ে ভালো থাকতে হবে, খাবারের বিষয়ে পরিমিতি জ্ঞান ও সংযম পালন করতে হবে। এভাবেই উৎসবও চলতেই থাকবে, স্বাস্থ্যটাও যেন ভালো থাকে। কারণ স্বাস্থ্য ভালো থাকলে উৎসবটাও ভালো কাটবে। সবাইকে মনে রাখতে হবে, এবারের ঈদ অন্য সাধারণ ঈদের মতো নয়। ঈদ উদযাপনের পাশাপাশি স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যাপারটি সবাইকে নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই।

কুরবানি ঈদের কিছু পরামর্শঃ-

* মাংস খাওয়ার লোভে পড়ে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে নিজের ওজন বাড়িয়ে বসবেন না। স্বাস্থ্যই সুখের মূল- কথাটা ভুললে চলবে না।

* গরু, মহিষ, খাসি ও ভেড়ার মাংসে থাকে প্রচুর পরিমাণে কোলেস্টেরল। বেশি মাংস খেলে দীর্ঘমেয়াদে আপনার স্বাস্থ্য বিশেষত হার্টের ক্ষতি হতে পারে।

* কম মাংস খাওয়ার জন্য বেশি বেশি মাংস গরিব মিসকিনকে দিয়ে দিন। মনে রাখবেন দৈনিক ৯০ গ্রামের উপর মাংস খেলে বেড়ে যাবে ক্যানসারসহ হার্টের রোগ।

* মাংসের চর্বিযুক্ত অংশ বাদ দেয়ার চেষ্টা করুন। এছাড়া মগজ, চর্বি এবং ভুড়ি না খাওয়াই ভালো।

* যদি মাংস খেতেই হয়, তাহলে সেদ্ধ ও কয়লায় পুড়িয়ে খাওয়ার চেষ্টা করুন। বিশেষ করে কাবাব খাওয়া সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর। বেশি তেল দিয়ে অতিরিক্ত ভাজা মাংস খাওয়া যাবে না।

* কখন খাবেন এ বিষয়ে ডায়েটিশিয়ান ও ডাক্তারদের উপদেশ মানুন। ঘুমানোর অন্তত দুই ঘণ্টা আগে রাতের খাওয়া শেষ করতে হবে। রাতের খাওয়া শেষে আধা ঘণ্টা হেঁটে আসুন।

* বেশি পরিমাণ মাংস যেহেতু খেতেই হবে তাই খাদ্যতালিকায় প্রচুর পরিমাণ মাংস রাখুন। একেবারে বেশি বেশি না খেয়ে একটু পরপর অল্প অল্প করে খান। মাংস খাওয়ার ফলে যেহেতু দৈনিক ক্যালরির পরিমাণ বেড়ে যায় তাই ডেজার্ট এবং মিষ্টি খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিন।

* ঈদের এই কয়েকদিনে অনেকগুলো দাওয়াত পাবেন। জানেন যে এড়াতে পারবেন না, মাংস খেতেই হবে। আর মাংস খেলে হবে হজমের গণ্ডগোল। তাই প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় চিনি ছাড়া লেবুর রস এবং গ্রিন টি রাখতে পারেন।

পরিশেষে বলতে চাই, পুষ্টি সচেতনতা নতুন কিছু নয়। সুস্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টিকর খাবারের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই সবসময় খেয়াল রাখুন আপনি কি খাচ্ছেন। স্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে পছন্দের সব ধরনের খাবার গ্রহণ করুন।

লেখক, প্রতিষ্ঠাতা,জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

ইমেইল,drmazed96@gmail.com

ভিডিও দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন

youtube
Patrika71.com
news