আজ পবিত্র শবে কদর : গুরুত্ব ও তাৎপর্য

অতিথি লেখক

২৮ এপ্রিল, ২০২২, ২ years আগে

আজ পবিত্র শবে কদর : গুরুত্ব ও তাৎপর্য

আজ বৃহস্পতিবার পবিত্র শবে কদর (লাইলাতুল কদর)। সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হবে শবে কদরের রজনী। এ রাত ‘হাজার মাসের চেয়েও উত্তম’। কারণ এই রাতে শেষ হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর ওপর পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হয় এবং এই রাতকে কেন্দ্র করে ‘কদর’ নামে একটি সুরাও নাজিল হয়।

তাই মুসলমানদের কাছে শবে কদর অত্যন্ত মহিমান্বিত একটি রাত। কদরের রাতটি ইবাদত-বন্দেগিতে কাটিয়ে দেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। আর মহাগ্রন্থ আল কোরআন নাজিল হওয়ার কারণে অন্যসব মাসের চেয়ে রমজান মাস বেশি ফজিলতময় হয়েছে।

আর রমজানের রাতগুলোর মধ্যে কোরআন নাজিলের রাত লাইলাতুল কদর সবচেয়ে তাৎপর্যমণ্ডিত একটি রাত। রমজানের শেষ ১০ এর যে কোনো বিজোড় রাতই এই মহিমান্বিত রাত হতে পারে। তাই বিজোড় রাতগুলোতে ইবাদত ও আমল করা উত্তম।

রজনী কী?

মহিমান্বিত কদর রজনী হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। সে রাতে ফেরেশতাগণ হজরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম সমভিব্যাহারে অবতরণ করেন; তাঁদের প্রভু মহান আল্লাহর নির্দেশ ও অনুমতিক্রমে, সব বিষয়ে শান্তির বার্তা নিয়ে। এই শান্তির ধারা চলতে থাকে উষা পর্যন্ত। (আল কোরআন, সুরা-৯৭ [২৫] আল কদর (মাক্কি), রুকু: ১/২২, আয়াত: ১-৫, মঞ্জিল: ৭, পারা: ৩০ আম্ম-সি পারা, পৃষ্ঠা ৬০৫/১৯)।

ভারতীয় উপমহাদেশ, পারস্যসহ পৃথিবীর অনেক দেশের ফারসি, উর্দু, বাংলা, হিন্দি নানা ভাষাভাষী মানুষের কাছে এটি ‘শবে কদর’ নামেই সমধিক পরিচিত।রমজান মাস পবিত্র কোরআন নাজিলের মাস। শবে কদর কোরআন নাজিলের রাত।

এ রাতেই প্রথম পবিত্র মক্কা মুকাররমার হেরা পর্বতের গুহায় মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে ফেরেশতাদের সরদার হজরত জিবরাইল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রতি মহাগ্রন্থ আল কোরআন অবতীর্ণ হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘রমজান মাস! যে মাসে কোরআন নাজিল হয়েছে মানবের দিশারি ও হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনরূপে।

(আল কোরআন, সুরা-২ আল বাকারা (মাদানি), রুকু: ২৩/৭, আয়াত: ১৮৫, মঞ্জিল: ১, পারা: ২ সাইয়াকুল, পৃষ্ঠা ২৯/৭)।কোরআন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব। আসমানি এক শ সহিফা, চারখানা কিতাবসহ মোট এক শ চারটি কিতাবের মধ্যে কোরআনই সেরা।

কারণ, এই কিতাব নাজিল হয়েছে আখেরি নবী, সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, নবীগণের ইমাম, রাসুলদের সরদার, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মুহাম্মাদ মুস্তফা আহমদ মুজতবা (সা.)-এর প্রতি। এই কোরআনের স্পর্শ বড়ই সৌভাগ্যের। হজরত জিবরাইল আলাইহিস সালাম এই কোরআন বহন করেই ফেরেশতাদের সরদার হওয়ার গৌরব লাভ করেছেন।

মরুর দেশ ‘জজিরাতুল আরব’ এই কোরআনের স্পর্শেই পবিত্র আরব ভূমির সম্মান লাভ করেছে। অলক্ষুনে ও দুর্ভোগময় খ্যাত ‘ইয়াসরিব’ এই কোরআনের বরকতেই পুণ্য ভূমি ‘মদিনা মুনাওয়ারা’র সম্মানে ধন্য হয়েছে। তাগুতের আখড়া পাপের আকর শিরক ও কুফরের শীর্ষ তীর্থস্থান ‘বাক্কা’ এই কোরআনের তাজাল্লিতে পবিত্র মক্কা নগরীতে রূপান্তরিত হয়েছে।

এই কোরআনের পরশে স্বল্পমূল্য কাপড়ের ‘গিলাফ’ বুকে জড়ানোর সম্মান পাচ্ছে। এই কোরআনের ছোঁয়ায় সাধারণ কাঠের ‘রেহাল’ সম্মানের চুমু পাচ্ছে।

সর্বোপরি কোরআনের সংস্পর্শে একটি সাধারণ রাত ‘লাইলাতুল কদর’ বা ‘শবে কদর’ রজনীর সম্মানে বিভূষিত হয়েছে। কোরআনের সঙ্গে যার যতটুকু সম্পর্ক ও সংস্পর্শ থাকবে, তিনি ততটুকু সম্মানিত ও মর্যাদার অধিকারী হবেন।

প্রিয় হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘কোরআনওয়ালাই আল্লাহওয়ালা এবং তাঁর খাস ব্যক্তি। (বুখারি শরিফ)। ‘যার অন্তরে কোরআনের সামান্যতম অংশও নেই, সে যেন এক বিরান বাড়ি।’ (বুখারি ও মুসলিম শরিফ)শবে কদর রমজানের মধ্যেই। রাসুলে আকরাম (সা.) বলেছেন: ‘তোমরা রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে শবে কদরকে সন্ধান করো। (মুসলিম)।

এ রাতগুলো হলো ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯। মনে রাখতে হবে, আরবিতে দিনের আগে রাত গণনা করা হয়।মুহাক্কিকগণ বলেন, আরবিতে ‘লাইলাতুল কদর’ শব্দদ্বয়ে নয়টি হরফ বা আরবি বর্ণ রয়েছে; আর সুরা কদরে ‘লাইলাতুল কদর’ শব্দদ্বয় তিনবার রয়েছে; নয়কে তিন দিয়ে গুণ করলে সাতাশ হয়, তাই সাতাশে রমজানের রাতে শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। (তাফসিরে মাযহারি)

হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! (সা.) আমি যদি লাইলাতুল কদর সম্পর্কে জানতে পারি, তাহলে আমি ওই রাতে আল্লাহর কাছে কী দোয়া করব? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন; তুমি বলবে, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন, তুহিব্বুল আফওয়া; ফাফু আন্নি।’ অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে ভালোবাসেন; তাই আমাকে ক্ষমা করে দিন।’

(ইবনে মাজা, সহিহ-আলবানি) হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে সওয়াবের নিয়তে কদরের রাত জেগে ইবাদত করবে, তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। (বুখারি শরিফ, ইমান অধ্যায়, পরিচ্ছেদ: ২৫, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা ২৯-৩০, হাদিস: ৩৪)

লাইলাতুল কদর রাতে আমলঃ

(ক) কদরের ফজিলত পাওয়ার উদ্দেশ্যে কিছু নফল ইবাদত করা, নফল নামাজ আদায় করা। কোরআন তেলাওয়াত করা, তাছবীহ তাহলীল পাঠ করা কর্তব্য। দুই দুই রাকআত করে নফলের নিয়ত করে যেকোনো সূরাই সূরা ফাতেহার সঙ্গে মিলিয়ে নামাজ পড়া যাবে। তাতে কোনো অসুবিধা নেই। উত্তম হলো নফল নামাজ ধীরে সুস্থে লম্বা লম্বা ক্বেরাত দিয়ে পড়া এবং ধীরস্থিরে রুকু-সিজদা আদায় করা।

(খ) লাইলাতুল কদর হলো বছরের শ্রেষ্ঠ রাত। এ রাতের শ্রেষ্ঠ দোয়া হলো ক্ষমা চাওয়ার দোয়া। এ রাতে মহানবী (সা.) ক্ষমা চাওয়ার দোয়া শিক্ষা দিলেন যে, তুমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাও, ক্ষমা পাওয়ার জন্য দোয়া করো। হাদীস শরীফে আছে হযরত আয়েশা (রা.) মহানবী (সা.) কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ইয়া রাসূল আল্লাহ! যদি আমি বুঝতে পারি শবে কদর কোন রাত, তাহলে ঐ রাতে আমি কি বলব? আল্লাহর কাছে কি চাইব?

প্রিয় নবী (সা.) তদুত্তরে বলেন তুমি বলবে, ‘হে আল্লাহ আপনি বড়ই ক্ষমাশীল। ক্ষমা করতে আপনি ভালবাসেন, তাই আমাকে ক্ষমা করে দিন। ’ আরবি দোয়া হলো- আল্লাহুম্মা ইন্নাকা, আফুউন তুহেববুল আফওয়া, ফাওফু আন্নি (ইবনে মাজাহ)।

কেউ যদি জীবনে অনেক কিছু পায় কিন্তু ক্ষমা না পায়, তাহলে তার জীবন ব্যর্থ। তাই এ রাতে অন্তরকে নরম করে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাওয়ার পূর্বে খাঁটি দিলে তওবা ইস্তেগফার করতে হয়।

খাঁটি তওবার চারটি শর্ত:

  • পূর্বের গুনাহ থেকে ফিরে আসা বা গুনাহ ছেড়ে দিতে হবে
  • গুনাহর জন্য মনে মনে অনুতপ্ত হতে হবে যে, আমি বড়ই অন্যায় করেছি
  • ভবিষ্যতে ওই গুনাহ আর করবো না বলে মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করতে হবে
  • বান্দাহর কোনো হক নষ্ট করে থাকলে যথাসাধ্য সে হক আদায় করে দিতে হবে।
(গ) এ রাতের আরেকটি আমল ফুকাহায়ে কিরামগণ বলেছেন যে, এ রাতে ইবাদাতের পূর্বে যদি কেউ গোসল করে নিতে পারে তার সেটাই উত্তম। উক্ত আমলগুলো শুধু ২৭ রমজান নয় বরং রমজানের শেষ দশ দিনের প্রত্যেক বেজোড় রাতে শবেকদর তালাশ করতে হবে।

এজন্য মহানবী (সা.) রমজানের শেষ দশ দিনে ইতেকাফ করতেন। আর উম্মতের জন্য শরীয়তে ইতেকাফের বিধান কিয়ামত পর্যন্ত জারি রেখে গিয়েছেন যেন তারা ইতেকাফের মাধ্যমে লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব দিয়ে প্রত্যেকটি বেজোড় রাতে এবাদত করতে পারেন।

আল্লাহ তায়ালা লাইলাতুল কদরে কোরআন নাজিল করেন। এ রাত বছরে একবার আসে আর চলে যায়। কিন্তু এ রাতের মহান নিয়ামত কোরআন মানব সমাজেই বিরাজমান থাকে চিরদিন। মানব জীবনে সাফল্য এই কোরআনের আমলের উপরই নির্ভরশীল। এই রাতের মর্যাদা মূল্যায়ন তখনই যথার্থ হবে।

যখন আমরা কোরআনের নির্দেশিত পথে চলবো, আর কোরআনের বাহক মুহম্মদ (সা.) এর পূর্ণাঙ্গ আনুগত্য করবো। এ রাতের সর্বাপেক্ষা মহৎ প্রাপ্তি হলো কোরআনের হক আদায় করা এবং আল্লাহর বান্দাদেরকে কোরআন প্রদর্শিত পথে পরিচালিত করার জন্য নিজেদেরকে সর্বদা প্রস্তুত করা।পরিশেষে আল্লাহ তায়ালা যেন সবাইকে লাইলাতুল কদর তালাশ করার তৌফিক দান করুন। সে অনুয়ারী আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক, এম এ কামিল হাদিস, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা

প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

ইমেইল, drmazed689@gmail. Com

ভিডিও দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন

youtube
Patrika71.com
news