চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের ৯৮তম জন্মবার্ষিকী

বিনোদন ডেস্ক

বিনোদন ডেস্ক

৯ আগস্ট, ২০২২, ১ year আগে

চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের ৯৮তম জন্মবার্ষিকী

বুধবার (১০আগস্ট) নড়াইলের লাল মিঞা তথা খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের ৯৮তম জন্মবার্ষিকী। ১৯২৪ সালের এই দিনে শহরের মাছিমদিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন বরেণ্য এই শিল্পী। দারিদ্রতার মাঝে বেড়ে ওঠা সুলতান ছোট বেলায় তাঁর মা মাজু বিবিকে হারান।

তাঁকে সঙ্গ দেয়ার কেউ না থাকায় রাজমিস্ত্রি বাবা মেছের আলীর সঙ্গে সঙ্গে থাকতেন এবং প্রায় বাড়ির পাশে নড়াইল জমিদার বাড়িতে যেতেন। বাবার সুনিপুন হাতে গড়া জমিদার বাড়ির কারুকাার্য খঁচিত ভবন, মন্দির, সুউচ্চ মিনার, নকশা, সিংহদ্বারে অঙ্কিত নানান চিত্র, মূর্তি ইত্যাদি শিশু সুলতানের মনে গভীর প্রভাব ফেলে, যা তাঁকে ছবি আঁকার প্রতি আকৃষ্ট করেছিল।

১৯৩৩ সালে নড়াইলে বেড়াতে আসা জমিদার শ্যামাপ্রাসাদ মুখোপাধ্যায়ের ছবি এঁকে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র সুলতান সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন এবং তার সুদৃষ্টিতে পড়েন। এ সূত্র ধরেই কলকাতায় চিত্রসমালোচক শাহেদ সোহরাওয়ার্দীর সুপারিশে ১৯৪১ সালে ভর্তি হন কলকাতা আর্ট কলেজে।

১৯৪৪ সালে তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হলেও তিনি কলেজ ছেড়ে চলে যান। শুরু হয় শিল্পীর ভিন্ন অধ্যায়। তিনি কাশ্মিরের পাহাড়ি অঞ্চলে উপজাতীয়দের সাথে বসবাস এবং তাদের জীবনযাত্রার ওপর ছবি আঁকা শুরু করেন। ১৯৪৬ সালে ভারতের সিমলায় শিল্পীর প্রথম চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।

এখান থেকে তিনি পাকিস্তাানে চলে যান। ১৯৪৮সালে লাহোরে এবং করাচীতে তাঁর একক চিত্র প্রদর্শনী হয়। ১৯৫০ সালে চিত্রশিল্পীদের আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে আমেরিকা যান সুলতান।

এরপর ইউরোপে বেশ কয়েকটি একক ও যৌথপ্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন তিনি। এ সময় বিখ্যাত চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো, সালভেদর দালি, পল ক্লী, কনেট, মাতিসসহ খ্যাতিমান চিত্রশিল্পীদের ছবির পাশে তাঁর ছবি স্থান পায়। হয়ে ওঠেন বিশ^বরেণ্য। ১৯৫৩ সালে সবার অগচরে পাকিস্তানের করাচি থেকে বরেণ্য এই শিল্পী সুলতান নিজ মাতৃভূমি নড়াইলে ফিরে এসে শিশু-কিশোরদের সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি চারুকলা শিক্ষার ব্যবস্থায় মনযোগ দেন।

১৯৫৫ সালে তিনি মামা বাড়ি নড়াইলের পুরুলিয়ায় ‘নন্দন কানন ফাইন আর্ট এন্ড স্কুল’, ১৯৬৯ সালে যশোর ‘একাডেমী অব ফাইন আর্ট স্কুল’, ১৯৭৮ সালে জন্মস্থান নড়াইলে ‘ফাইন আর্ট স্কুল’ এবং ১৯৮৭ সালে “শিশুস্বর্গ” নামে শিশুদের ছবি আঁকার প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।

১৯৯৩ সালে শিশুদের নিয়ে ভ্রমন এবং নৌকা ছবি আঁকা শেখাবার জন্য তৈরী করেন বিশাল দোতলা বিশিষ্ট ভ্রমন তরী বজরা (নৌকা)। এছাড়া একই বছরে চিত্রাংকন, নৃত্য ও সঙ্গীত শিক্ষার জন্য ‘লাল বাউল সম্প্রদায়’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলেন। এদিকে বাংলাদেশেও বরেণ্য এই চিত্রকরের একাধিক চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।

১৯৭৬সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ১৯৮৭ সালে জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ১৯৯৩ সালে শিল্পাঙ্গনে জলরঙ প্রদর্শনী ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে তার শেষ প্রদর্শনী হয়। এর পরের বছর ১৯৯৪ সালের অক্টোবরে তার ছবির মরণোত্তর প্রদর্শনী হয় শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে।

চিত্রশিল্পের মূল্যায়ন হিসেবে এস.এম সুলতান ১৯৮২ সালে ‘একুশে পদক’, ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের ‘রেসিডেন্ট আর্টিস্ট’ স্বীকৃতি, ১৯৮৬সালে ‘বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ সম্মাননা’ এবং ১৯৯৩ সালে ‘স্বাধীনতা পদক’ পান। এছাড়াও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’, নিউইয়র্কের বায়োগ্রাফিক্যাল সেন্টার থেকে ‘ম্যান অব অ্যাচিভমেন্ট’ এবং এশিয়া উইক পত্রিকা থেকে ‘ম্যান অব এশিয়া’ পুরস্কার লাভ করেন।

শিল্পীর মৃত্যুর পর শহরের কুরিগ্রামে তার বাসভবন, শিশুদের ছবি আঁকার প্রতিষ্ঠান শিশুস্বর্গ, শিশুদের জন্য নির্মিত ইঞ্জিন চালিত নৌকা, সমাধিস্থল, শিল্পীর ব্যবহৃত জিনিসপত্র ও তাঁর অংকিত ছবিকে ঘিরে সুলতান কমপ্লেক্স গড়ে ওঠে। ২০০৬ সাল থেকে এটি চালু হলেও কমপ্লেক্সটি পূর্ণতা পায়নি।

২ একর ৫৭ শতক জমির ওপর এটি নির্মিত হবার কথা থাকলেও কমপ্লেক্স সংলগ্ন ৫জন জমির মালিক ৭৮শতাংশ জমির ক্ষতিপূরণ না পাওয়ায় সরকার এ জমির মালিকানা হাতে পায়নি। শিশুদের জন্য নির্মিত সুলতানের নৌকাটি সংস্কারের অভাবে নষ্ট হচ্ছে। কমপ্লেক্স সংলগ্ন যেখানে নৌকাটি রাখা হয়েছে সে স্থানটি নদী ভাঙ্গণের কবলে পড়েছে।

দর্শনার্থীদের বাড়তি বিনোদনের জন্য নৌকার পাশের্ ২০১৮সালে পর্যটনবান্ধব দৃষ্টিনন্দন ‘সুলতান ঘাট’-এর নির্মাণ কাজ শুরু হলেও তা বন্ধ হয়ে যায়। শিল্পীর ছবিগুলো দীর্ঘ বছর বদ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকায় কমপ্লেক্সে স্থান পাওয়া ছবিগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। গত কয়েক বছরে ৭টি ছবি রিপিয়ার হলেও কাজের মান নিয়ে স্থানীয় চিত্রশিল্পীদের অভিযোগ রয়েছে।

শিল্পীর ছবিগুলোকে টেকসই করতে নতুন একটি চিত্র গ্যালারি নির্মাণ করার কথা থাকলেও তা থমকে রয়েছে। শিল্পী সুলতানের সবচেয়ে বড়ো স্বপ্ন ‘শিশুস্বর্গ’ ভবনে শিশুদের জন্য ছবি আঁকার ব্যবস্থা করা হলেও তা বিভিন্নভাবে বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে। শিল্পীর মৃত্যুর ২০০১ সাল থেকে সুলতান ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ‘সুলতান স্বর্ণ পদক’ চালু করা হয়েছে।

শিল্পীর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে দেশের একজন গুণী চিত্রশিল্পীকে এ পদক দেয়া হয়। ২০০৯ সালে শিল্পী সুলতানের বাগান বাড়ি শহরের পশ্চিম মাছিমদিয়ায় ‘এস এম সুলতান বেঙ্গল চারুকলা মহাবিদ্যালয়’প্রতিষ্ঠা করা হয়। সুলতানের শিল্পকর্মের বিষয়বস্তু ছিলো-কৃষক, জেলে, তাঁতি কামার, কুমার, মাঠ, নদী, বিল-খাল সবুজ প্রান্তর প্রভৃতি।

তিনি এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষ, কৃষক, শ্রমিককে পেশীবহুল ও শক্তিশালী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। সুলতান জানতেন, এই কৃষকই সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাই তারা কখনও দূর্বল হতে পারে না। মানবতাবাদী সুলতান চিত্রাংকনের পাশাপাশি বাঁশিসহ অন্যান্য সুরযন্ত্র বাজাতেও পটু ছিলেন।

তার সঙ্গী ছিলো-বিভিন্ন প্রজাতির পশু ও পাখি। কথিত রয়েছে বিষধর সাপও তাঁর বাঁশির সুর শুনে মাথা নাড়াত। গুণী এই শিল্পী শুধু চিত্রকলাকে সমৃদ্ধ করেননি,এর পাশাপাশি তিনি বাঙ্গালির মনন ও মানবিকতা বিকাশে, শিক্ষার বিকাশে, খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোরের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শিল্পী সুলতান মৃত্যুবরণ করেন। বুধবার শিল্পীর জন্মবার্ষিকীতে কমপ্লেক্স চত্বরে কোরআন খানি, ৯টায় শিল্পীর মাজারে পুস্পমাল্য অর্পণ, দোয়া অনুষ্ঠান, মিষ্টি বিতরণ, দিনব্যাপি শিশুদের আর্টক্যাম্প, চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা, পুরস্কার বিতরণ ও স্মরণসভা।

এছাড়া ১০ আগস্ট থেকে সুলতান কমপ্লেক্সে শিল্পী সুলতানের ওপর ভিডিও ডুকুমেন্টরি চালু হচ্ছে। কমপ্লেক্সের অভ্যন্তরে অডিও ভিজ্যুয়াল কক্ষে সকাল ১০টায় এর উদ্বোধন করবেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখন থেকে প্রতিদিন এখানে দর্শনার্থীরা প্রায় ১০-১৫মিঃ শিল্পী সুলতানের ওপর নির্মিত বিভিন্ন ডুকুমেন্টরি দেখার সুযোগ পাবেন। দেশের বড়ো বড়ো মিউজিয়ামগুলো যেভাবে চলে আস্তে আস্তে সেভাবে করার চেষ্টা করছি।

পত্রিকাএকাত্তর /হাফিজুল নিলু

ভিডিও দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন

youtube
Patrika71.com
news