চট্রগ্রামের চেরাগীতে পালিত হলো "আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস"

চট্টগ্রাম মহানগর প্রতিনিধি

৯ আগস্ট, ২০২২, ১ year আগে

চট্রগ্রামের চেরাগীতে পালিত হলো "আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস"

চট্টগ্রাম শহরে অবস্থানকারী পার্বত্য জেলার অধিবাসীদের আয়োজনে চট্টগ্রামের চেরাগী পাহাড় মোড়ে অনুষ্ঠিত হলো আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। আজ ৯ আগস্ট মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সর্ব উপস্থিতিতে বিভিন্ন আয়োজনে পালিত হয় এই দিবস।

আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ২০২২। ১৯৯৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ৪৯/২১৪ ধারা অনুয়ায়ী প্রতি বছরের ৯ আগস্টকে আদিবাসী দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়। সেই থেকে বিশ্বের ৯০ টি দেশের প্রায় ৪৭৬ মিলিয়ন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী এই দিবসটি পালনের মাধ্যমে তাদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, চিরায়ত ঐতিহ্য উপস্থাপনের পাশাপাশি বিভিন্ন দাবি-দাওয়া, অধিকারের কথা রাষ্ট্র এবং বিশ্বের কাছে তুলে ধরে।

শতাব্দীকাল ধরে শোষণ, বঞ্চনা ও জাতিগত আগ্রাসনের শিকার হয়ে বিপন্ন হওয়া আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বকীয় ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য তথা আদিবাসী জীবন সুরক্ষায় এ দিনটি বিশেষ তাৎপর্য্য বহন করে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীও এই দিনটিকে বিশেষ মর্যাদায় পালন করে আসছে।

কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলেও সত্য, বিগত সময়ের তুলনায় দেশের আদিবাসীদের উপড় যুগ যুগ ধরে চলমান রাষ্ট্রীয় সহিংসতা, শোষণ, ভূমি বেদখল, আদিবাসী নারী নির্যাতনসহ নিপীড়নের মাত্রা আরো বেশী বৃদ্ধি পেয়েছে। কাপেং ফাউন্ডেশনের করা মানবাধিকার রিপোর্ট-২০২১-এ দেখা গেছে শুধুমাত্র ২০২১ সালে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন তথাকথিত উন্নয়ন কর্মকান্ডের নামে আদিবাসীদের প্রায় ১,০৯৬ একর জমি বেদখল করে নেওয়া হয়েছে।

৬ জন আদিবাসী নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে যাদের মধ্যে ২ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এবছরের এপ্রিল মাসে বান্দরবানের লামায় স্থানীয় আদিবাসীদের ভূমি বেদখলের নিমিত্তে প্রায় ৩৫০ একর জুমভূমি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে টাঙ্গাইল, মধুপুরের আদিবাসীদের ভূমি দখলের জন্য ইকোপার্ক স্থাপনের প্রক্রিয়া এখনো চলমান।

সিলেটের আদিবাসী খাসিয়াদের পানজুম, পুঞ্জিগুলো প্রতিনিয়ত বেদখল করার অপচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। শুধু তাই নয়, সমতল এবং পাহাড়ের আদিবাসীদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন মানবাধিকার কর্মীদের নামে ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে।

এমনতর এক বাস্তবতায় দেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠী আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ২০২২ পালন করতে যাচ্ছে, যে সময়ে স্বয়ং দেশের তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক গণমাধ্যমগুলোকে, বিভিন্ন প্রগতিশীল ও বুদ্ধিজীবিদের “আদিবাসী” শব্দ ব্যবহার না করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।

অথচ বাংলাদেশের সংবিধানে সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, সংবিধানের কোনো ধারা বা বিষয় নিয়ে কোনো বিতর্ক বা মতান্তর দেখা দিলে তার ব্যাখ্যা একমাত্র দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টই দিতে পারবে। অন্য কোন প্রতিষ্ঠান, গোষ্ঠী বা ব্যক্তি নয়।

আর বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্টেরই এক রায়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে, “আদিবাসী” শব্দটি ব্যবহারে কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই। শুধু তাই নয়, বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস-২০০৯ এ দেওয়া এক বাণীতে আদিবাসীদের নিজস্ব পরিচয়ে সব অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ওপর বলিষ্ঠ ভাষায় গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।

জাতিসংঘ প্রতিবছর আদিবাসী দিবসের একটি নির্দিষ্ট প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে দেয়। এবছরের প্রতিপাদ্য বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম জাতিসংঘ ঘোষিত এ মূলসুরের সাথে সংগতি রেখে বাংলায় অনুবাদ করেছে- “ঐতিহ্যগত বিদ্যা সংরক্ষণ ও বিকাশে আদিবাসী নারী সমাজের ভূমিকা।”

আদিবাসী নারীরা আদিবাসী সমাজের ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণের মূল চাবিকাঠি। এ বারের আদিবাসী দিবসে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম নিম্নোক্ত দাবি জানাচ্ছে-

১. সংবিধানে আদিবাসী জনগণের জাতিগত পরিচয় ও আত্ব-নিয়ন্ত্রনের স্বীকৃতি দিতে হবে।

২. বাংলাদেশের আদিবাসীদের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও ভূমির অধিকার দিতে হবে।

৩. পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। এ লক্ষ্যে সময়সূচি ভিত্তিক কর্ম পরিকল্পনা বা রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। ভূমি কমিশন আইন অবিলম্বে কার্যকর করতে হবে।

৪. সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের ভূমি সমস্যা সমাধানের জন্য অবিলম্বে ভূমি কমিশন ও মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

৫. মৌলভীবাজার ও মধুপুরে ইকোপার্ক, গাইবান্ধায় ইপিজেড প্রকল্প, মধুপুরে অরুণখোলা মৌজার রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা, আমতলী বাইদে লেক নির্মাণ প্রকল্প বাতিল করতে হবে।

৬. আদিবাসীদের ভূমিতে সামাজিক বনায়ন, ইকো ট্যুরিজম, ইপিজেড ও অন্য কোন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা যাবে না।

৭. আদিবাসীদের উপর সকল নিপীড়ণ নির্যাতন বন্ধ করাসহ সকল মিথ্যা মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।

৮. বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে আদিবাসীদের জন্য আসন সংরক্ষণ করতে হবে এবং সমতলের আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে স্থানীয় সরকার পরিষদে (পৌরসভা, ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদ) আদিবাসীদের জন্য আসন সংরক্ষণ করতে হবে।

৯. বাংলাদেশের আদিবাসীদের জন্য শিক্ষা ও চাকরি কোটা পুনর্বহালসহ (১ম ও ২য় শ্রেণী) ও কোটা বৃদ্ধি ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

১০. জাতীয় বাজেটে আদিবাসী উন্নয়নে বিশেষ বরাদ্ধের ব্যবস্থা করা।

১১. জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ২০০৭ সালে গৃহিত আদিবাসী বিষয়ক ঘোষণাপত্র ও আইএলও ১৬৯ নং কনভেনশন অনুসমর্থন ও আইএলও কনভেনশন-

১০. ৭ বাস্তবায়ন করা।

১২. জাতিসংঘ ঘোষিত ৯ আগস্ট ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস’ রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা।

পত্রিকাএকাত্তর /ইসমাইল ইমন

ভিডিও দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন

youtube
Patrika71.com
news