অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, গোমস্তাপুরে পুকুর লীজ, না পুকুর চুরি?

স্টাফ রিপোর্টার, গোমস্তাপুর

৮ জুন, ২০২২, ১ year আগে

অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, গোমস্তাপুরে পুকুর লীজ, না পুকুর চুরি?

চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরে ভূমি অফিসের অধীনে সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত তিন বছর মেয়াদী পুকুর/জলমহাল লীজ নিয়ে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। সরকারি খাস পুকুর/জলমহাল নীতিমালা অনুযায়ী মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সমিতিগুলো ইজারার মাধ্যমে লীজ গ্রহণ করার কথা। সেখানে কিছু অসাধু চক্রের কাছে অনেক পুকুর লীজ দেয়া হয়েছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।

অসাধু চক্রের মূল ভূমিকায় গোমস্তাপুর উপজেলা ভূমি অফিসে কর্মরত গাড়ী চালক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও প্রসেস সার্ভারসহ অনেকেই। এর সাথে যুক্ত রয়েছে উপজেলার কিছু পুকুর খেকো মানুষ। ভূমি অফিসের কারও কারও সহযোগিতা নিয়ে কিছু অসাধু চক্র সমিতির কাগজপত্র বিভিন্ন দপ্তর থেকে ম্যানেজ করে লীজে অংশগ্রহণ করেছে। পরবর্তীতে সে পুকুরগুলো মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে অন্যের নিকট বিক্রি করেছে বলে গোপন সূত্রে জানা গেছে।

যে সব সমিতির কাগজপত্র নিয়ে লীজে অংশগ্রহণ করা হয়েছে সে সকল সমিতির অনেকেই জানেনা তাদের সমিতির কাগজপত্র নিয়ে পুকুর লীজ নেয়া হয়েছে। অসাধু চক্র গোমস্তাপুর উপজেলার বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে সমিতির কাগজপত্র ম্যানেজ করেছে।

আর যে সমস্ত সরকারি দপ্তর সমিতির কাগজপত্র সরবরাহ করেছে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, সমাজসেবা অধিদপ্তর, সমবায় অফিস, বিআরডিবি অফিস ও আমার বাড়ি আমার খামার এর কর্মকর্তারা মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে অসাধু লীজ চক্রকে সমিতি পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

আর যারা টাকা দিতে অপারগতা জানিয়েছিল তাদের পুকুর লীজ নেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিতে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলো তালবাহানা করেছে। পরবর্তীতে টাকা ফেরত দিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পুকুর লীজ নিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে হামলা মামলার অভিযোগও রয়েছে। আর এসব হামলা মামলার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে পাওয়া গেছে কোন সমিতি বৈধভাবে পুকুর লীজ নিলে সেক্ষেত্রে অসাধু চক্র সেই সমিতির লীজকৃত পুকুরে ক্ষতিসাধন করার চেষ্টা করে। ফলে বৈধ লিজ গ্রহীতাদের হয়রানি ও হামলা-মামলার শিকার হতে হয়।

পুকুর লীজ চক্রের মূলহোতা গোমস্তাপুর উপজেলা ভূমি অফিসের মাস্টার রোলে কর্মরত গাড়ী চালক আবু সুফিয়ান সাগর এর সাথে কথা বলে জানা যায়, সাগর ও তার সহযোগীরা ৫/৬টি করে পুকুর লীজ নিয়েছে। তার সাথে রয়েছে ভূমি অফিসের পরিচ্ছন্নতাকর্মী আরিফ আলী, প্রসেস সার্ভার মফিজুল হক রানু। এছাড়াও রাঙ্গামাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মাতিন, দেওপুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বারিকুল ইসলাম, লক্ষীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আতিকুর রহমান সহ অনেকের বিরুদ্ধে পুকুর লীজ প্রক্রিয়ার সাথে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, এই চক্র প্রায় ৬০ থেকে ৭০ টি পুকুর খুব স্বল্পমূল্যে গ্রহণ করে অন্যের কাছে চড়া দামে বিক্রি করেছে যা সাবলীজ নামে পরিচিত।কথা প্রসঙ্গে সাগর জানায়, আমি ৫/৬টি পুকুর লীজ নিয়ে খাচ্ছি। এটা সমিতির কাছ থেকে কিনে নিয়েছি। প্রতিবেদককের সাথে কথা বলার সময় সাগর দূর্ব্যবহারকরেন এবং সাংবাদিক সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করেন।কথা হয় পরিচ্ছন্নতাকর্মী আরিফের সাথে, তিনি জানান, আমি ও সাগর মিলে ৮/১০ টি পুকুর লীজ নিয়ে নিজেরা চাষাবাদ করে খাচ্ছি। আমার সাথে সাগর ও বারিকুল মাস্টার রয়েছে।

এ বিষয়ে আরও কথা হয় রহনপুর পৌর এলাকার রহমতপাড়ার পুকুর ব্যবসায়ী নামে পরিচিত সোহেলের সাথে । তিনি জানান, আমি নিজেই ৭টি পুকুর লীজ গ্রহণ করে চাষাবাদ করে খাচ্ছি । যেখানে একটি সমিতি সর্বোচ্চ ২টি পুকুর নিতে পারে সেখানে আপনি ৭টি পুকুর লীজ নিয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এমন নিয়ম নীতি আমি বুঝি না, আমার ব্যবসা করার কাজ আমি তাই করছি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ব্যক্তির সাক্ষাতে জানা গেছে, পুকুর লীজ চক্রের সাথে আরো কয়েকজন জড়িত। তাদের মধ্যে রহনপুর পৌর এলাকার কাঠিহার পাড়ার আব্দুল হাকিম, হলপাড়ার রনজিত, রহনপুর ইউনিয়নের রতনপুর গ্রামের মুনসুর আলী সহ অনেকে। এরা সকলেই অনিয়মের মধ্য দিয়ে একেক জন বেশ কয়েকটি করে পুকুর/জলাশয় ভূমি অফিস থেকে স্বল্প মূল্যে লীজ নিয়ে অন্যের কাছে চড়া দামে বিক্রয় করেছে।

রহনপুরের জনৈক সিরাজুল ইসলাম, লীজ চক্রের অন্যতম সদস্য বারিকুল মাষ্টারের কাছে প্রায় ৫ হাজার টাকা সরকারি মূল্যের ২টি পুকুর আমি ৮০ হাজার টাকায় কিনে নিয়েছি।

এ বিষয়ে উপজেলা সমবায় অফিসার নাদিম উদ্দিনের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, আমি সরকারি পুকুর লীজ সংক্রান্ত কমিটির একজন সদস্য। অথচ আমাকে না জানিয়ে অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। সিদ্ধান্ত হওয়ার পরে আমার কাছে স্বাক্ষর নিতে আসলে আমি স্বাক্ষর করি নাই।

আপনার অফিসের নিয়ন্ত্রণাধীন সমিতিগুলো পুকুর লীজ প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার সমিতির সদস্যরা পুকুর লীজ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেছে। তবে তিনি পুকুর লীজে অনিয়মের বিষয়টি প্রকারন্তরে স্বীকার করেছেন।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা.কাওসার আলী জানান,তার অধীনস্থ সমিতিগুলো পুকুর লীজ প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে কিছু পুকুর পেয়েছে। তবে তারা পুকুরগুলো লীজ নিয়ে নিজেরা চাষ করছে, না অন্যের কাছে বিক্রি করেছে তাঁর সেই বিষয়ে জানা নেই। পুকুর লীজ নিয়ে অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভূমি অফিসের দালাল চক্র অনিয়মের সাথে যুক্ত থাকতে পারে।

এছাড়া পুকুর লীজ কার্যক্রমে প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে আমার বাড়ি আমার খামারের গোমস্তাপুর উপজেলার সাবেক সমন্বয়কারী ইফতে খাইরুলের সম্পৃক্ততাও মিলেছে। এ বিষয়ে জানার জন্য তাঁর মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

পুকুর লীজের অনিয়মের বিষয়ে গোমস্তাপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহরিয়ার নজির এর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ৩টি ধাপে পুকুর লীজ দেয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। তন্মধ্যে ১৪২৮-২৯ বঙ্গাব্দে ৩য় দফায় ২৭২টি, ১৪২৯-৩০ বঙ্গাব্দে ১৯টি, ১৪২৯-৩১ বঙ্গাব্দে ৩৭৯টি। ৩য় ধাপের পুকুর লীজ প্রক্রিয়া এখনও চলমান রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, নীতিমালা মেনে পুকুর লীজ দেয়া হয়েছে। তবে ৩য় ধাপে পুকুর লীজ প্রদানের ক্ষেত্রে কিছুটা শীথিলতা থাকায় অনেকেই এই লীজ প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছে। তাছাড়া অনেকেই পুকুর লীজ নিয়েও ডিসিআর কাটেনি।

এর কারণ হিসাবে তিনি পুকুরের অবস্থান খারাপ ও অন্যের দখলে রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। তার অফিসের কিছু কর্মচারী পুকুর লীজ প্রক্রিয়ায় সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বিষয়টি জানেন বলে প্রতিবেদককে জানিয়েছেন। এর কারণ হিসেবে তিনি সরকারের রাজস্ব আয়ের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছেন।

এ বিষয়ে উপজেলা নিবার্হী অফিসার আসমা খাতুনের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, আমি নতুন যোগদান করেছি। এ বিষয়টি আমার জানা ছিল না। তবে যেহেতু আপনারা আমাকে এখন জানালেন। তাই আমি বিষয়টি খতিয়ে দেখবো এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্হা গ্রহন করবো।

উল্লেখ্য, লীজ গ্রহীতা কোন মৎস্যজীবী সংগঠন /সমিতি তাদের নামে লীজকৃত জলমহাল কোন অবস্থাতেই সাব-লীজ অথবা অন্য কোনো ব্যক্তি/গোষ্ঠীকে হস্তান্তর করতে পারবে না এবং অন্য কোন উপায়ে তা ব্যবহার করতে পারবে না।

যদি তা করে থাকে তাহলে উপজেলা নির্বাহি অফিসার গোমস্তাপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ উক্ত লীজ বাতিল করে দিবেন এবং জমাকৃত লীজমানি সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করবেন। উক্ত লীজ গ্রহীতা মৎস্যজীবী সংগঠন/সমিতি পরবর্তী বছর জলমহাল ইজারা সংক্রান্ত কোনো আবেদন করতে পারবে না। আরও উল্লেখ থাকে যে, সরকারি খাস পুকুর ও জলমহল নীতিমালা অনুযায়ী একটি সমিতি সর্বোচ্চ ২টি পুকুর লীজ গ্রহণ করতে পারবে।

এলাকাবাসী পুকুর লীজ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সঠিকভাবে সরেজমিনে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহনের দাবী করেছেন।

পত্রিকাএকাত্তর/ইয়াহিয়া খান রুবেল

ভিডিও দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন

youtube
Patrika71.com
news