সাভারে স্বামীর প্রতারণার শিকার স্কুল শিক্ষিকা গৃহবধূ

সাভার প্রতিনিধি

২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২২, ২ years আগে

সাভারে স্বামীর প্রতারণার শিকার স্কুল শিক্ষিকা গৃহবধূ

রাজধানীতে যশোরের চৌগাছা উপজেলার মনম্মথপুর গ্রামের মৃত ছানার উদ্দিন মন্ডলের ছেলে মো: সিরাজুল ইসলামের সাথে বিয়ে হয় রংপুর জেলার বদরগঞ্জ থানার সন্তোষপুর আফানের পাড়া গ্রামের মৃত আফান উদ্দিনের মেয়ে বীরফুল বেগমের সাথে। বিয়ের পর প্রতারণার শিকার হয়েছেন ওই গৃহবধূ। এ ঘটনায় গৃহবধূর ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে সম্প্রতি তালাক প্রদান করেছেন প্রতারক সিরাজুল ইসলাম। আর এই কাণ্ডে তার সহযোগিতায় রয়েছেন একটি চক্র।

কয়েকদিন ধরেই প্রতারণার শিকার হয়ে বিচার চেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন গৃহবধূ বীরফুল বেগম। তিনি সাভার পৌরসভার ছায়াবীথি এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করেন। বীরফুল বেগম সাভারের একটি স্কুলে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন।

তার প্রতারক স্বামীও একই বাসায় বসবাস করে আসছিলেন। স্ত্রীর বিশ্বস্ততা অর্জনে প্রতারক স্বামী মো: সিরাজুল ইসলামও সাভারের একটি টেইলার্সের দোকানে চাকুরী নেন।

জানা গেছে, ২০১৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বীরফুল বেগম কে ফাঁদে ফেলে বিয়ে করেন মোঃ সিরাজুল ইসলাম। ৭ বছর ৭ মাস ২৭ দিন সংসার জীবনে বিলফুল বেগমের বাপের বাড়ির জমি বিক্রির প্রায় ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে ২০২১ সালের অক্টোবর মাসের ১০ তারিখে তাকে তালাক দেয়।

যশোর জেলার চৌগাছা থানার মোহাম্মদপুর গ্রামের বাসিন্দা হাজী ইমাম হোসেন জানান, সিরাজুল ইসলাম ছোটবেলা থেকেই উদ্ভট প্রকৃতির। লেখাপড়ায় পারদর্শী না হলেও ঠান্ডা ফুরফুরে কথায় অনেক মেয়ের সর্বনাশ করেছে সে। সিরাজুল ইসলাম বিয়ের আগে এলাকার উঠতি বয়সের মেয়েদের ডিস্টার্ব করার কারণে বিচার সালিশ হয়। সালিশে তার বাবা ছানার উদ্দিন মন্ডল সিরাইজ'যা কে বিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে লিখিত মুচলেকায় বাড়িতে নিয়ে যান। তার বাবা মারা যাওয়ার পর সে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠে। আল্লাহ যেন তার বাবাকে জান্নাত দান করেন।

স্থানীয় আরেক বাসিন্দা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্কুল শিক্ষক জানান, সিরাজুল ইসলাম যশোরের মোহাম্মদপুর গ্রামের মাস্টার নামে পরিচিত। তবে আমরা শিক্ষকতা পেশায় থাকলেও আমাদের থেকে তার মাস্টার নামের কদর অনেক বেশি। হাজী ইমাম হোসেনের কথার সূত্র ধরে ওই স্কুল শিক্ষকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এলাকায় তাকে নিয়ে একবার শালির হয় সেই সালিশের পর যশোরের সদর ইউনিয়নের আজিজ কমান্ডারের বোন অন্যের ঘরে সংসার করা অবস্থায় ফুসলিয়ে আছিয়া বেগমকে বিয়ে করেন তিনি। পরে তার ঔরসজাত হাফিজুর রহমান মিলন এবং নীলিমা বেগম নামের দুই সন্তান রয়েছে।

এ ব্যাপারে তার প্রথম স্ত্রী আছিয়া বেগমের আত্মীয় রহিমা বেগমের সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, আমাদের আছিয়া অনেক ভালো মনের মানুষ ছিল। লম্পট সিরাজুল তার জীবনটা খাইল। আরো কয়েকদিন এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারত তবে সিরাজুল তাকে বাঁচতে দেয় নি। কি এমন হয়েছে জানতে চাইলে রহিমা বেগম বলেন, অনেক ঝয় ঝামেলার পর সিরাজুল আছিয়াকে বিয়ে করেন। দুইটা বাচ্চা বড় ছেলে হাফিজুর রহমান মিলন এবং মেয়ে নীলিমা বেগম হওয়ার পর ঠুনকো বিষয় নিয়ে তালাক দেয় আছিয়াকে।

তালাকের ৬ মাসের মধ্যে রাজশাহীর রোজী বেগমকে বিয়ে করেন। বিয়ের ২ বছর সংসার করার পর তাকেও তালাক দেয় সিরাজুল ইসলাম নামের ওই প্রতারক। রোজিকে তালাকের ৩ মাসের মধ্যে আবারো প্রথম স্ত্রী আছিয়া বেগমকে বিয়ে করেন। ১৯৮৯ সালে আবারো আছিয়ার গর্ভে সন্তান ধারণ করেন সিরাজুল ইসলাম। পরে দিলারা ইসলাম মনিরা নামের আরেক কন্যা সন্তান জন্ম হয়।

এই প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় সিরাজুল ইসলামের দ্বিতীয় স্ত্রী রাজশাহীর রোজী বেগমের সঙ্গে তিনি জানান, তার প্রথম স্ত্রী ছিল এমনটা জানলে আগে কখনোই ওই প্রতারককে বিয়ে করতাম না। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস সে আমাকে বিভিন্নভাবে প্রস্তাব পাঠিয়ে আমার পরিবার এবং আমাকে রাজি করায় কিন্তু বিয়ের পর পর তার অস্বাভাবিক চলাফেরা আমার কাছে সন্দেহজনক মনে হলে তার এলাকা যশোরে যাই। খবর পাই তার আগে বিয়ে আছে এবং ওই ঘরে দুই সন্তান রয়েছে। এরপর শুরু হয় ঝগড়া পরে আমাকে সে জোরপূর্বক তালাক দেয়। আবারও সেই আগের সংসারে মগ্ন থাকে। আল্লাহ ওর বিচার করবে! বলতে বলতে কেঁদে দেন ওই নারী।

প্রথম স্ত্রী আছিয়া বেগমের মৃত্যুর বিষয়টি জানতে আবারো যোগাযোগ করা হয় আত্মীয় রহিমা বেগমের সাথে। পরবর্তীতে তিনি বলেন, আছিয়া বেগমের মতো নারী ঘরে ঘরে প্রয়োজন। ওর মত মেয়েই হয় না কিন্তু লম্পট সিরাজুল ইসলামের মতো স্বামীদের জন্য তাদের ভাগ্য খারাপ হয়। কি আর বলবো.? ২০১৩ সালে ছেলের বউ আমাদের বৌমা মঞ্জুয়ারার সাথে অনৈতিক সম্পর্কে জড়ায় শশুর সিরাজুল ইসলাম। পরে সংসার টিকানোর জন্য ছেলে ক্ষুব্দ হলে ছেলের বউয়ের নামে তার নিজস্ব দুই তলা ভবন লিখে দেন। এই দুঃখে তার প্রথম স্ত্রী আছিয়া বেগম স্ট্রোক করে ২০১৩ সালের ১১ অক্টোবর শুক্রবার মারা যান।

এরপর ২০১৪ সালের ১৪ ই ফেব্রুয়ারি ২০ হাজার টাকার কাবিন মূলে স্বামী পরিত্যাক্তা বীরফুল বেগম (বিপুল) কে বিয়ে করেন সিরাজুল ইসলাম নামের ওই ছদ্দবেশী। শুরু হয় সংসার এবং লগ্ন মাধুরীর প্রতারণা।

প্রতারণার শিকার গৃহবধূ বীরফুল বেগম বলেন, আমি পড়ালেখা করা অবস্থায় এনজিওতে চাকরি নেই। এরপর আমার বিয়ে হয়। সংসার জীবন ও এনজিওতে চাকরি করার সুবাদে যশোর জেলায় বসবাস শুরু করি। সেখানে সিরাজুল ইসলামের বাড়িতে বাসা ভাড়া নেই। আমার প্রথম স্বামী এক হত্যা মামলায় জড়িয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়। সেই ঘরে আমার এক পুত্র সন্তান রয়েছে।

আমার দণ্ডিত স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি জেল গেট থেকে আমাকে ফিরিয়ে দেন। দীর্ঘদিন ধরে আমি সন্তানকে নিয়েই চাকরি করে জীবন যাপন পরিচালনা করি। এক পর্যায়ে সিরাজুল ইসলামের প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তার কন্যারা আমার সাথে যোগাযোগ করে। আমাকে বলে আন্টি আমার মা মারা যাওয়ার পর থেকেই বাবা কেমন যেন হয়ে গেছে। অন্য মেয়েদের সাথে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে গেলে আমাদের ইজ্জত নষ্ট হয়ে যাবে। প্লিজ আমার বাবার জীবনে আপনি স্ত্রী হিসেবে আমাদের আগলে রাখুন। কিছুদিন সময় নেই। তাদের উপর্যুপুরি চাপ এবং আমার অসহায়ত্ব সব দিক চিন্তা করে যথাযথ আইন মেনে সিরাজুল ইসলামকে দ্বিতীয় বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেই।

রাজধানীর মিরপুরে সিরাজুলের মেয়ে নীলিমা বেগমের বাসস্থান সংলগ্ন পল্লবীর কাজী আবদুল হোসেন সিদ্দিকীর অফিসে আমাকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সালে ২০ হাজার টাকা কাবিন নামায় বিয়ে রেজিস্ট্রি হয়। সেখানেও বিলফুল বেগমের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। হিসেব অনুযায়ী তার সিরাজুলের তৃতীয় স্ত্রী হওয়ার কথা।

প্রতিবেদক এর হাতে আসা অভিযোগের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২১ সালের ১০ অক্টোবর গৃহবধূ বীরফুল বেগমকে তালাক প্রদান করে প্রতারক মোঃ সিরাজুল ইসলাম। তালাক প্রদানের তিন মাস না পেরোতেই ২ মাস ২২ দিনের মাথায় ২০২২ সালের পহেলা জানুয়ারি আরেক স্বামী পরিত্যাক্তা নারীকে বিয়ে করেন সিরাজুল।

তাদের ৭ বছর ৭ মাস ২৭ দিন সংসার চলাকালে ২০১৭ সালের ২৫ জুন রোড এক্সিডেন্ট করে পা ভেঙ্গে দীর্ঘ এক বছর সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন সিরাজুল ইসলাম। এই সমস্ত চিকিৎসার প্রায় ৫ লক্ষ টাকা ব্যয় ভার বহন করেন গৃহবধূ বীরফুল বেগম। এতে মন গলে যায় প্রতারক সিরাজুলের, পরে ২০১৮ সালের ২১ অক্টোবর যশোরের ৯৬ নং মোহাম্মদপুর মৌজার আর এস ৬৩ নং খতিয়ানের মালিকের ওয়ারিশ সূত্র হিসেবে আর.এস ৪০৪ নং দাগের ১০ শতক জমি বিলফুল বেগমকে লিখে দেন। দলিল নং - ৫৭৩৮ /১৮ ।

এদিকে পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতারক চক্রটি সিরাজুল কর্তৃক বীরফুল বেগমকে দেওয়া ওই ১০ শতক জমি পেতে ছেলের বউ মঞ্জুয়ারার চাপে তালাকের ৮ দিনের মাথায় দলিলটি - ৫৭৩৮ /১৮ বাতিল চেয়ে যশোরের চৌগাছায় বিজ্ঞ সহকারি জজ আদালতে মামলা দায়ের করেন(মামলা নং - ২৯৪/২১ যা বিচারাধীন। আবার ২০২১ সালের ৭ ডিসেম্বর একইভাবে জমিটি যেন নামজারি(খারিজ) না করা হয় যশোরের চৌগাছা উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি বরাবর এমন একটি আবেদন পত্র দেয় প্রতারক মো: সিরাজুল ইসলাম। বিজ্ঞ বিচারক এবং সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি ন্যায় বিচারের আবেদন জানিয়েছেন প্রতারণার শিকার গৃহবধূ বীরফুল বেগম।

এদিকে বীরফুল বেগম বাদী হয়ে জেলা রংপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট বদরগঞ্জ আমলি আদালতে প্রতারক সিরাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছেন মামলা নং- ২৭ /২২ ।

অভিযোগের বিষয়ে সিরাজুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি সকল অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমার উপর অত্যাচারের মাত্রা এতটাই বেড়ে যায় যে, সে একজন স্ত্রীলোক হয়ে আমাকে শারীরিক অত্যাচারের চরম পর্যায়ে নিয়ে যায়। এজন্য সাভারের বাসার আসবাবপত্র রেখে মিরপুরে মেয়েদের কাছে চলে যাই। তার সাথে এখন আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমার দেওয়া জমিটুকু আমি নিয়ে নিবো। খোরপোষ সহ তালাক দিয়ে সব সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। অন্য এক প্রশ্নে উত্তর না দিয়ে বিষয়টি এড়িয়ে যান এবং দ্রুত সেখান থেকে স্থান ত্যাগ করেন।

পত্রিকা একাত্তর/মোঃ সোহাগ হাওলাদার

ভিডিও দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন

youtube
Patrika71.com
news