ভাষার গানের স্রষ্টা স্বীকৃতি পাননি এখনো

জেলা প্রতিনিধি | বাগেরহাট

জেলা প্রতিনিধি | বাগেরহাট

২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২২, ২ years আগে

ভাষার গানের স্রষ্টা স্বীকৃতি পাননি এখনো

২১ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার, ১৯৫২ সাল। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে মিছিলে নেমেছে বাংলার দামাল ছেলেরা। চারদিক কাঁপিয়ে স্লোগানের পরে স্লোগান ‘১৪৪ ধারা মানি না, মানবো না’। কলা ভবন থেকে বের হয়ে মিছিল এগিয়ে চলছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের দিকে। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে কোনো রকম পূর্ব সংকেত ছাড়াই আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করতে থাকে।

গুলিতে নিহত হন রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত-সহ আরও অনেকে। প্রতিবাদ স্বরুপ সেদিন রাতেই বাগেরহাটের চারণ কবি শেখ শামসুদ্দিন আহমদ রচনা করেন “রাষ্ট্রভাষা” নামে ভাষা আন্দোলনের প্রথম গান।

‘রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনও করিলিরে বাঙলী,

তোরে ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি।

ও বাঙ্গালী…ও ওওও।

​​​​​​পরবর্তীতে আন্দোলন-সংগ্রামে নিজের লেখা গান গেয়ে ছাত্র-জনতাকে উদ্বুদ্ধ করতেন তিনি। জানা যায়, সে সময় তিনি শহরের বিভিন্ন স্থানে তার রচিত ‘রাষ্ট্রভাষা’ গান গেয়ে ভাষা অন্দোলন গতি সঞ্চার করেন। তার এ গান এতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে স্বল্প সময়ে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পরে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময়ও গানটি অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের। অথচ ৭০ বছরেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি ভাষা আন্দোলনের প্রথম গানের গীতিকার ও সুরকার কবি শামসুদ্দিন। কবিকে তার প্রাপ্য সন্মান দেওয়ার দাবী জানিয়েছেন পরিবার ও এলাকাবাসী। তবে কবিকে মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক।

১৯১৫ সালে বর্তমান বাগেরহাট জেলার সদর উপজেলার বেমরতা ইউনিয়নের ফতেপুর গ্রামে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন চারণকবি শামসুদ্দিন। তার বাল্যশিক্ষা শুরু হয় বাগেরহাট টাউন স্কুলে (বর্তমান বাগেরহাট বহুমুখী কলেজিয়েট স্কুল)। এখানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত তিনি লোখাপড়া করেন। তবে পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে তার উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ হয়নি।

শামসুদ্দিনের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। অভাবের সংসারে শামসুদ্দিনের ছেলেমেয়েরাও পড়ালেখা করতে পারেনি। এর মধ্যে মেয়ে লাইলি বেগম মারা গেছে বছর খানেক আগে। ছোট ছেলে মুকুল শেখ ঢাকায় চাকুরী করেন। শামসুদ্দিনের বড় ছেলে শেখ দেলোয়ার হোসেন খোকন বাড়িতেই থাকেন। তিনি বলেন, আমার বাবা হাটবাজারে ফেরি করে বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি করতেন। একইসঙ্গে গান লিখতেন। ভাষা আন্দোলন নিয়েও তিনি গান লিখেন। গানগুলো জনপ্রিয়ও ছিল। তবু তিনি রাষ্ট্রীয় কোনও স্বীকৃতি পাননি। আমরা চাই অন্তত মরণোত্তর সন্মাননা যেন তিনি পান।

ফতেপুর গ্রামের বাসিন্দা এনামুল হক বলেন, চরণ কবি শেখ শামসুদ্দিন ছিলেন একজন ভাষা সৈনিক। ভাষা আন্দোলনের সময় লেখা তার গান সারা বাংলাদেশে তখন আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো,অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলো ভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িত ছাত্র-জনতার মধ্যে। অথচ ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পার হলেও এখনও কেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি তিনি পাননি। সরকারের কাছে আমাদের এলাকাবাসীর দাবী ভাষা আন্দোলনের প্রথম গানের গীতিকার ও সুরকার এই কবিকে রাষ্ট্রীয় ভাবে স্বীকৃতি দেয়া হোক।

বেমরতা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনোয়ার হোসেন টগর বলেন, স্থানীয় ভাবে কবির সম্মানে তার বাড়ীর সামনে একটি গেট, কবরটা বাধাইসহ ইউনিয়ন পরিষদে কবির নামে একটি পাঠাগার নির্মান করা হয়েছে। তবে রাষ্ট্রীয় ভাবে তিনি আজ পর্যন্ত স্বীকৃতি পাননি। সরকারের কাছে প্রয়াত কবির মরনোত্তর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি জানান এই জনপ্রতিনিধি।

বাগেরহাটের প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মোজাফ্ফর হোসেন বলেন, চারণকবি শামসুদ্দিন পেশায় তেলবিক্রেতা ছিলেন। তবে ছোটবেলা থেকেই তিনি গান পরিবেশনা করতেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তার প্রথম গান গনজাগরণে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। ভাষা আন্দোলনের পরে অনেক অনুষ্ঠানে-ই চারণকবি শামসুদ্দিনকে নিয়ে যাওয়া হতো গান পরিবেশনের জন্য। তবে পরবর্তী সময়ে অভাব-অনটনে ভুগে তার মৃত্যু হয়।

বাগেরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বলেন, ভাষা আন্দোলনে সময় চরণ কবি শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ তার গানের মাধ্যমে জনসাধারণকে ভাষা আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। কবির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এছাড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কবির পরিবারের সদস্যদের সহযোগীতা করার আশ্বাস দেন তিনি।

১৯৭৪ সালে তার বাবা শামসুদ্দিনের জীবনাবসান ঘটে। বাগেরহাট-পিরোজপুর সড়কের পাশে নিজ গ্রাম ফতেহপুরে চারণ কবি শামসুদ্দিন চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন।

পত্রিকা একাত্তর/ শেখ আবু তালেব

ভিডিও দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন

youtube
Patrika71.com
news