বাজান দুগ্গা ভাত খাওয়াইবেন, এহনও কিছু খাই নাই

উপজেলা প্রতিনিধি, আমতলী

৩১ জানুয়ারী, ২০২২, ২ years আগে

বাজান দুগ্গা ভাত খাওয়াইবেন, এহনও কিছু খাই নাই
ফাইল ছবি | পত্রিকা একাত্তর

বাড়িতে কেউ আছেন মাগো? কয়ডা (কয়টা) ভিক্ষা দেন। হঠাৎ এমন ডাকে জেগে উঠলাম। আমি তখনও ঘুমোচ্ছিলাম। যদিও বেলা তখন ১১ টার কাছাকাছি। যাইহোক বাহিরে নেমে দেখি কাঁচুমাচু দেয়া এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে। বয়স অনুমান করলাম ১০০ পেরিয়ে গিয়েছে। শীতে কাঁপতেছে। কিন্তু শরীরে কোনো শীতের পোশাক ছিল না, শুধু হাজারও তালি দেয়া একটি পাঞ্জাবি পরা।

জিজ্ঞেস করলাম, চাচা কাকে চান? বলল, কাউরে (কাউকে) না বাজান, ভিক্ষার লইগা (জন্য) আইছি (আসছি)। কয়ডা (কয়টা) ভিক্ষা দিবেন? বললাম, দাড়ান নিয়া আসতেছি। এরপর ঘর থেকে কিছু চাল নিয়ে আসলাম লোকটির জন্য। এরপর চাল নিয়ে সে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে আর আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি। আহা! বেচারা নিজেই হাঁটতে পারতেছে না আবার ভিক্ষা করতেছে।

আমি ঘরে ঢুকব এমন সময় আবার দেখি আমার দিকে ফিরে আসতেছে। তখন আবার দাঁড়ালাম। ভাবলাম কিছু ফেলে গেছে হয়ত। এরপর কাছে এসে আমার দিকে তাকিয়ে একটু মৃদু হাসি দিয়ে বলল, বাজান একখান (একটা) কথা কমু (বলমু) আমনে (আপনি) কি রাগ হইবেন(হবেন) তাতে? না চাচা, আপনি বলেন কি বলবেন। বাজান দুগ্গা (কয়টা) ভাত খাওয়াইবেন (খাওয়াবেন), এহনও (এখনও) কিছু খাই নাই। আমি অবাক হয়ে গেলাম। এত বেলা হল এখনও কিছু খাননি কেন? বলল, সকালে অল্পদুগ্গা (অল্পকিছু) পান্তাভাত(পানি দেয়া ভাত) আছিল কিন্তু তা নাতিডায় (নাতি) খাইয়া (খেয়ে) ফালাইছে (ফেলছে)। ঘরেও আর চাউল (চাল) আছিলো না। শুনে একটু খারাপ লাগলো। বললাম, আচ্ছা ঘরে উঠে বসেন আমি খাবার দিতেছি। শুনে খুশি হল। আমি আম্মুকে খাবার দিতে বললাম।

সেদিন ঘরে তেমনকিছু ছিল না। আলু আর ছোটমাছ। তাই দিয়েই খেতে দিলাম। খেতে খেতে বলল, বাজান মরিচ আছে? আছে। মরিচ এনে দিলাম। খাবারের গতি দেখে যতটুকু বুঝলাম তরকারির থেকে মরিচেই তার রুচি বেশী। কিন্তু তার কাপুনির বিষয়টিও আমার নজর এড়ালো না। একবার ভাত মুখে দিতে ১০বার চেষ্টা করতে হয়। যখন পানি খায় তখন গ্লাস আর দাঁতের সাথে ছোট ছোট আঘাতের কারনে টুংটাং শব্দ বের হয়। এমন আরও কিছু বিষয় আমার নজর এড়ালো না। এসব দেখে তার বিষয়ে জানতে আগ্রহী হলাম। খাবার ভিতরেই তাকে নানা প্রশ্ন করা শুরু করলাম। চাচাও খাবারের সাথে যুদ্ধ চালাচ্ছে আর ফাঁকে ফাঁকে আমার উত্তর দিচ্ছে।

উত্তর অনুযায়ী চাচার সম্পর্কে!

চাচার নাম তজুমুদ্দিন (কাল্পনিক নাম)। তার হিসেবমতে বয়স ১০০ বছর অনেক আগেই ছাড়িয়ে গেছে। শরীরে ভর করেছে নানান রোগ। স্ত্রী অনেক আগেই গত হয়েছেন। মা মারা যাবার পর ছেলেরা বাবার কোনো খোঁজ নেয় না। তাই চাচার ঠাই হয়েছে তার মেয়ের বাড়িতে। কিন্তু মেয়েরও যে বড় অভাবের সংসার। কিছুদিন আগে তারও স্বামী মারা গিয়েছে। আর মারা যাবার আগে থাকার জায়গাটুকু ব্যতীত কিছুই রেখে যাননি। আছে দু-চারটি হাঁস মুরগি, তার ডিম বিক্রি করেই চাল ডাল কিনত। দশ বছর বয়সি একটি ছেলে আছে তার। সে'তো কোনো উপার্জন করতে পারে না। তাই একদিন খেতে পারলেও পরেরদিন সবাই উপোষ। এমনি ভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিলো তাদের। এমনই অনাটনের মধ্যে আবার ঠাই দিয়েছেন বাবাকেও। এখনতো সংসারের চাকা মোটেই ঘুরছে না।

বয়সের কাছে চাচা হার মেনে গিয়েছে। এখন আর কোনো কাজ সে করতে পারেনা। শেষমেস কোনো উপায় না পেয়ে ভিক্ষার কথা চিন্তা করে। অভাবের তাড়নায় মেয়েও তার অচল বাবাকে ভিক্ষা করতে বারন করেনি। তাই চাচা এখন অসুস্থ শরীরে ভিক্ষা করে বেড়ান। এখন দিনশেষে যা পায় তাই দিয়ে দুবেলা চলে যায়। জিজ্ঞেস করলাম, সরকারি কোনো অনুদান পান না? বলল, বয়স্ক ভাতায় একখান নাম আছে। অনেকদিন পরপর ১০০০ টাহা (টাকা) পাই, কিন্তু তা দিয়ে ঔষধই খাইতে হয়। বেশী অসুস্থ হইলেতো আর ভিক্ষাও করতে পারমু না। মাইয়া (মেয়ে) আর নাতিডা (নাতি) আমার দিকে চাইয়া (চেয়ে) থাহে (থাকে)। চাল নিয়া বাড়ি ফিরলে রান্ধন (রান্না) হয়। তারপর সবাই একসাথে খাই। মুইতো (আমিতো) সকাল দূপুর মাইনষের(অন্যের) বাড়িতে খাই কিন্তু অরা (তারা) দুইজন প্রায়দিনই থাহে(থাকে) উপোস। চাচা এইভাবে আর কতদিন চলবে? বলল, কিছুতো আর করার নাই বাজান। যদ্দিন (যতদিন) বাঁইচ্চা (বেঁচে) আছি এমন কইরাই (করেই) চলতে হইব (হবে)। পাশাপাশি আমাকেও দু-একটি প্রশ্ন করলেন। আমিও উত্তর দিলাম।

কথা বলতে বলতে চাচার খাবার শেষ হল। এরপর দুহাত উপরে তুলে আমাদের জন্য অনেকক্ষন দোয়া করলেন। এবার যাবার পালা। আমি তখন তাকে ১০০ টাকা দিলাম। টাকা দেয়ার পর আমায় বলল, বাজান(বাবা) ভিক্ষা খুবই খারাপ কাজ। আল্লায় (আল্লাহ) যেন এমন খারাপ কাজে কাউরে (কাউকে) আর না আনে। সব বাড়ির মানুষ এক না। অনেক বাড়ির মানুষ গালিও দেয়, ভিক্ষা করে খাই ক্যান(কেন) তাই। বলেই কেঁদে দিল। চাচার কান্না দেখে আমি নিস্তব্দ হয়ে গেলাম। এক পলকে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কিছু বলতে পারলাম না।

চাচা কাঁদতে কাঁদতেই বিদায় নিল। মাঝে মাঝে একহাত দিয়ে চোখ মুচ্ছে আর অন্যহাতে ছেঁড়া ব্যাগটি নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভিতরে ঢুকি। ঘরে গিয়ে দেখি মায়ের চোখটাও জলে ভর্তি। আমি বুঝতে পারলাম, মা ওপাশ থেকে চাচার সবকথা শুনেছে। আমায় দেখেই চোখ মুছলো আর বলল একটা কথা মনে রাখবি, বাবা মায়েরা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার সন্তানদের বটবৃক্ষের মত ছায়া দেয়। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে এসে যখন সেই বাবা মাকে ভিক্ষার থালা হাতে নিতে হয় তখন তার থেকে কষ্টের আর কিছু নেই। ঐ বৃদ্ধলোকটি চোখের পানি দিয়ে তাই বুঝিয়ে দিয়ে গেল।

আমি মায়ের কথাগুলো মন থেকে অনুভব করতে পারি। তাই আর কিছু বলিনি। চুপ করে রুমে চলে আসি। আসলে তখনও আমি ভাবছি চাচার মেয়ের কথা। সে এখনও বসে আছে তার বাবার ছেঁড়া ব্যাগটির অপেক্ষায়।

পত্রিকা একাত্তর/আবু সালেহ মুসা

ভিডিও দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন

youtube
Patrika71.com
news