পলাতক শাকিলের আবেগঘন স্ট্যাটাস, স্ত্রীর মৃত্যু নিয়ে যা বলল

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি

১০ মে, ২০২২, ১ year আগে

পলাতক শাকিলের আবেগঘন স্ট্যাটাস, স্ত্রীর মৃত্যু নিয়ে যা বলল

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ইংরেজি বিভাগের ২০১৬-২০১৭ শিক্ষাবর্ষের মেধাবী শিক্ষার্থী অঙ্কন বিশ্বাস রোববার (৮ মে) রাত সাড়ে ১১ টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের (বিএসএমএমইউ) আইসিউতে চিকিৎসারত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মঙ্গলবার (১০ মে) অঙ্কনের স্বামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী শাকিল আহমেদের একটি স্ট্যাটাস দেন। স্ট্যাটাসটি পত্রিকা একাওর পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো-

এই মুহূর্তে কোনো কিছু লেখার মত মানসিক অবস্থায় আমি ছিলাম না। যার যায়, সেই সবচেয়ে ভালো বোঝে। কিন্তু ব্যাপারগুলোকে যেভাবে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে তাতে কিছু বিষয় পরিষ্কার করা জরুরি। অংকনের সানী নামে এক বন্ধু বিষদ একটি লিখা লিখেছে যেটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি চর্চা হচ্ছে। লেখাটি বড্ড বেশি একপেশে, আবেগতাড়িত, কিছুটা অতিরঞ্জিত এবং অবশ্যই প্রকৃত সত্যের ছায়া মাত্র। আমি প্রত্যেকটা বিষয়ের ব্যাখ্যা দিচ্ছি।

১. বেশ কিছু নিউজে বলা হচ্ছে আমি বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছি, সম্পর্ককে অস্বীকার করেছি, তাই এই ঘটনা ঘটেছে। আবার সানীর স্ট্যাটাসে বলা হচ্ছে আমি জোর করে বিয়ে করেছি। জোর করে সম্পর্ক টিকিয়ে রেখেছি। তাহলে আমি কি প্রমান করবো? মেয়েটিকে আমি বিয়ে করতে চেয়েছি নাকি চাইনি? সম্পর্ক আমি ধরে রাখতে চেয়েছি নাকি চাইনি? প্রকৃত সত্য হচ্ছে আমাদের দীর্ঘ প্রায় ৫ বছরের সম্পর্ক। সব সম্পর্কের মত এখানে উত্থান পতন ছিলো, ভাঙাগড়া ছিলো, ঝগড়া মনোমালিন্য ছিলো। কিন্তু দিনশেষে সব কিছু পাশ কাটিয়ে আমরা ভালো ছিলাম।

(একটা দীর্ঘ সময়ের সম্পর্ক একপাক্ষিক, জোরকৃত হয় না। সেখানে মায়া, টান এসবের বন্ধন খুব ঠুনকো হয় না। এসবের বহু প্রমান আমার কাছে আছে।)

২. একটা ছেলে সম্পর্ক করে মেয়েটাকে বিয়ে না করলে চরিত্রহীন, আবার বিয়ে করতে চাইলেও সেটা খারাপ। তাহলে যাবেটা কই? বিয়ে করার প্ল্যান আমাদের বহু আগে থেকেই ছিলো। গত কয়েকমাস আগে হঠাৎ ওর বাসা থেকে বিয়ের ব্যাপারে তোরজোর শুরু করা হয়। তারপরেই আমরা আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা এগিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিই। সেটা সম্পূর্ণরুপে দুইপক্ষের সম্মতিতে। কিন্তু এটা সত্য ও ওর মা বাবার মেনে না নেয়া, বিয়ের পরে ওকে তাদের ঘৃণা করা, সম্প্রদায়ের অন্য লোকদের মাধ্যমে ওদের ফ্যামিলির কটু কথা শোনা এসব নিয়ে ভয়ে থাকতো৷ আর এই ব্যাপারগুলোতে ওকে আমি সবসময় মানসিকভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করতাম যাতে ওর ভয় দূর হয়।

** কোর্টে ওর পক্ষের কেউ ছিলো না এর সবচেয়ে বড় কারন ও নিজেই চাইতো না, ও বাসা থেকে চলে আসার আগ পর্যন্ত এটা কেউ জানুক। নইলে অংকন তার এত পার্সোনাল বিষয় বন্ধুদের সাথে শেয়ার করেছে, বিয়ে হয়ে গেছে এটা কেনো করলো না? বিয়ের ব্যাপারেও ওর বন্ধুরা হাসপাতালে আমার মাধ্যমেই জানতে পারে। ওই চাইতো একবারে সবাইকে জানাবে।

৩. এবার আসি ওর মা বাবার কাছে বলে দেবার ভয় দেখানোর কথা যেটা সম্পূর্ণই ভুল উপস্থাপনা। আমার কাছে ওর ফ্যামিলির মোটামুটি সবার নাম্বারই আছে। কিন্তু এই পাঁচ বছরে একটা উদাহরণ পাওয়া যাবে না যে প্রয়োজনে অপ্রোয়জনে আমি কখনো একবারের জন্য কোনো ফোন সেখানে দিয়েছি। একবার ওর বাসায় পাত্র দেখতে আসে, আর সেই সময়টা ও খুব ভেঙে পড়ে। একদিন সারাদিন ওর খোঁজ পাচ্ছিলাম না। ফোনে, ম্যাসেঞ্জারে, হোয়াটসঅ্যাপে কোথাও না।

আমি পাগলের মত হয়ে গেলাম। সারাদিন অপেক্ষা করে রাতে সানীকে ফোন দিয়ে সুইটির নাম্বার নিলাম। সুইটিকে ফোন দিয়ে ওর মায়ের নাম্বার সুইটিকে দিয়ে বললাম এটায় ফোন দিয়ে দেখো ওকে পাওয়া যায় কিনা। তবুও আমি নিজে একবারের জন্য ওই নম্বরে ফোন দেই নাই। ওর সাথে আমার বেশিরভাগ ভুল বোঝাবুঝি চ্যাট বা ফোনে হতো। কিন্তু সামনাসামনি আসলে আমাদের আবার সব ঠিক হয়ে যেতো। সামনাসামনি ওকে যেকোনো কিছু বোঝানো সহজ হতো। তাই ঝগড়া বা ভুল বোঝাবুঝি হলে ওকে আমি বাসার নিচে বা কাছে কোথাও দেখা করতে বলতাম।

৪. আইইএলটিএস, বাইরে যাওয়া ইত্যাদি প্রসঙ্গ। সানী একদম মিথ্যা কথা বললো যে ওর সাথে অঙ্কন আইইএলটিএস এ ভর্তি হয়েছে। কিন্তু সত্য হলো অংকনকে আইইএলটিএস কোচিং এ ভর্তি করিয়েছি আমি নিজে। সাথে নিয়ন আর সুইটিকেও। সানী আলাদা জায়গায় কোচিং করতো। ওর হায়ার স্টাডিজ এর জন্য প্রতিনিয়ত ডিপার্টমেন্ট এর ছোট ভাই মাহবুব (ইউকে তে অধ্যয়নরত) এর সাথে কনসাল্ট করতাম। ওকে সেসব বিষয় আবার জানাতাম, সাহায্য করতাম।

ও কিভাবে একটা ভালো ফরেইন স্কলারশীপ পেতে পারে এসব খোঁজখবর নিতাম। ওর সাথে আলোচনা করতাম। ওর প্রতিটা কাজে প্রতিটা ব্যাপারে প্রত্যক্ষভাবে ওর পাশে থেকেছি। ডিপার্ট্মেন্টের এসাইনমেন্ট করে দেয়া থেকে শুরু করে, টিচ ফর বাংলাদেশের ফেলোশিপ এর লেসন প্লান তৈরি করা, ডিবেট এর স্ক্রিপ্ট এমন কিছু নাই যেগুলো আমি ওকে সরাসরি হেল্প করতাম না। নিজে ইংলিশ ডিপার্ট্মেন্টের না হয়েও ওর লিটারেচার টেক্সট পড়ে পড়ে নিজে বুঝে তারপর ওকে লিটারেচার বুঝাতাম।

** একটা খুব সহজ প্রশ্ন। আমার এত অত্যাচার, এত মানসিক যন্ত্রণায় থেকে মেয়েটা ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হলো কিভাবে? উল্লেখ্য ওর সর্বশেষ দুই সেমিস্টার এর সিজিপিএ অপেক্ষাকৃত সবচেয়ে ভালো। ওর নাচ, গান, ডিবেট সবই সমানতালে চলেছে প্রতিটা মুহূর্তে। তবে এখানে একটা কিন্তু আছে।

একটু বলবেন কোন সম্পর্কটা একদম স্মুথ থাকে সারাজীবন? কোন সম্পর্কে কিছু ভেতরের কথা থাকে না? বিভিন্ন সময়ে ঝগড়ার মাঝে রাগ করে এটা ওটা করতে মানা করতাম, কিন্তু সেটা শুধুই সাময়িক রাগ থেকে বলা। এরপরে আবার সেটা ভুলে যেতাম আমরা। আইইএলটিএস নিয়ে একদিন ঝগড়ার মধ্যে বলেছি করা লাগবে না, আবার তার পরের ক্লাসই কিন্তু ও করেছে। কেননা ওগুলা সাময়িক সময়ের রাগ মাত্র। এগুলো ধরে জাজমেন্টাল হলে আমাদের বেশিরভাগ সম্পর্কই মূল্যহীন।

৫. ঘটনার আগের দিন ইফতারের বিষয়ে আসি। তার আগে কিছু প্রাসঙ্গিক কথা বলে নিই। অঙ্কন বন্ধুদের সাথে ঘুরতে, আড্ডা দিতে খুব পছন্দ করতো। এটা অনেকেই করে। কিন্তু ওর বাবা আবার খুব স্ট্রিক্ট। তাকে খুব ভয়ও পেতো ও। তার কথার বিপরীতে কোন কথা বলতো না। বাবা বাসায় থাকলে ও ক্লাস না থাকলে বের হয় না।

এছাড়া সন্ধ্যার আগে আগে বাসায় ফেরার ওর একটা তাড়া থাকতো সবসময়। এটাও অনেক মেয়ের ক্ষেত্রেই হয়। কিন্তু এত ভয়, এত রেস্ট্রিকশন ও মাঝে মধ্যেই বন্ধুদের জন্য ওভারকাম করে ফেলতো। যেই মেয়ের এত রেস্ট্রিকশন, এতো বাবার ভয়, সেই মেয়ে শুধু বন্ধুদের জন্য বাসায় মিথ্যা কথা বলে থার্টি ফার্স্ট নাইটে সারারাত বন্ধুদের সাথে বাইরে ছিলো।

যেই মেয়ে বাবাকে এত ভয় পায় সে বাবার চরম দ্বিমত সত্ত্বেও বাবার সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে সেইন্টমার্টিন ট্যুরে গিয়েছিলো। এই ঘটনায় ওর বাবা ওর সাথে একমাস কথা বলেনি। যাই হোক, ওর যেটা ভালো লাগে ও করবে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিতো বন্ধুদের জন্য অনেক মিথ্যা কথা বললেও আমার সাথে ইফতার করতে ও ভয় পেতো কারন সন্ধ্যার মধ্যে বাবা বাসায় চলে আসবে। এই বিষয়গুলো আমাকে খুব পীড়া দিতো যে এক ঘন্টার ইফতার করতে সমস্যা কিন্তু বন্ধুদের সাথে ও ঠিকই বাইরে ছিলো বাবাকে মিথ্যা বলে।

যাই হোক, ঘটনার আগের দিন ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট এলামনাই এর ইফতার ছিলো এবং আমারও ওখানে থাকার কথা। ওকে আমি দুপুরে বললাম ও আসবে কিনা। ও আমাকে বললো বাবা বাসায়। সম্ভব না। আমি বললাম ঠিক আছে। বিকেলে আবার ও-ই আমাকে বললো সে আসতেছে কারন ওর বন্ধুরা ওকে জোর করতেছে। এটা তখন আমার খুব খারাপ লাগে। আমি আসতে বললে আসলো না, এখন বন্ধুরা আসবে বলে আসতেছে। তাই তখন আমি রাগ করে ওকে ওখানে আসতে নিষেধ করি, যেটা ওর খুব খারাপ লাগে। তারপর ওর সাথে আমার কিছু সময় মনোমালিন্য হয় এবং রাতেই আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়।

৬. সানীর সাথে আমার ঘটনার আগের দিনও দেখা হয়। এছাড়া ক্যাম্পাসে প্রায়ই কথা হতো। মাঝে মধ্যে চ্যাট হতো। কখনোই সে অঙ্কনের ব্যাপারে, অঙ্কনের কষ্ট নিয়ে কিছু বলেনি। এমনকি তাদের পক্ষ থেকে কখনোই কোন যোগাযোগ করেনি। সানীর ভাষ্য সঠিক হলে তখন তাদের পক্ষ থেকে সুরাহা করার চেষ্টা কেন করলো না! এখন কেন একপেশে বক্তব্য।

৭. আমি পলাতক কিনা! খুবই আশ্চর্যজনক কথাটা। ঘটনার শুরু থেকে আজকে পর্যন্ত এক মুহুর্তের জন্য অংকনের ফ্যামিলির সাথে আমার যোগাযোগ বিচ্যুত হয়নি। ঘটনার সময় আমিই ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাই, পুরোটা সময় হাসপাতালে থাকি। ওর ফ্যামিলি মেম্বার মা, বাবা, কাকা, দিদা, দিদার হাসবেন্ড প্রত্যেকের সাথে আলাদা আলাদাভাবে সমস্তদিনই কথা বলি আমি। রাত হয়ে গেলে সবাই যখন বাসায় যাবে, আমি যেতে চাইনি। ওর ফ্যামিলি থেকেই আমাকে ওখানে না থাকতে বলা হলো।

পরের দিন আবার আমি হাসপাতালে যাই। এভাবে টানা ২/৩ দিন যাওয়ার পরে আমাকে দেখলেই অংকনের অন্য বন্ধুদের সহ আমাদের ওখান থেকে চলে যেতে বলা হতো। যেটা সানীর স্ট্যাটাসেও আছে। আইসিইউ ছিলো ৪র্থ তলায়। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে ৫ তলার সিড়িতে গিয়ে বসে থাকতাম। ওর অন্য বন্ধুরাও থাকতো। (সিসিটিভি ফুটেজ দেখলেই এসবের সত্যতা পাওয়া যাবে)। এরপরে অংকনের বন্ধুরাও আমার উপস্থিতি ভালোভাবে নিচ্ছিলো না।

একসময় আমার সাথে ফোনেও আপডেট দেয়া বন্ধ করে দিলো। তবুও আমি প্রতিদিনই হাসপাতালের আশেপাশে যেতাম এবং ওর খোঁজখবর নেয়ার চেষ্টা করতাম। ওর দুই একজন বন্ধু এটা জানে। এরপরে ওকে আসগর আলী থেকে পিজিতে নেয়া হলো। এই পুরো সময়ে প্রতিনিয়ত ওর পরিবারের সাথে আমার ফোন, হোয়াটস এপে যোগাযোগ হতো। কখনো ২০ মিনিট, কখনো ৩০ মিনিটও এক নাগাড়ে কথা হতো। তারা বিভিন্ন জিনিস জানতে চাইতো, ঘটনা ইনভেস্টিগেট করতো। আমি প্রতিটা বিষয়ে পুঙখানুপূংখভাবে তাদের সহোযোগিতা করতাম। উল্লেখ্য গতকাল, এমনকি ওর মৃত্যুর ২ ঘন্টা আগেও ওর দিদার সাথে আমার কথা হয়েছে।

৮. অঙ্কনের সাথে আমার ঘটনার আগের রাতে, এবং ঘটনার দিন সকালে খুবই স্বাভাবিক কথাবার্তা হয়। যার বিশদ ব্যাখ্যা ওর পরিবারকে আমি দিয়েছি। এবং সবকিছু স্বাভাবিক থাকার কারনেই আমি বুঝতেই পারিনি ও হঠাৎ করে বাসায় এসেই কেন অসুস্থ হয়ে গেলো। বাসার আসার ২/৩ মিনিটের মাথায়ই বললো চোখে অন্ধকার দেখছে। ডাক্তারের কাছে যাবে। আমি ভাবলাম রোদ থেকে আসার জন্য এমন হইছে। এর বাইরে ও খাবার নিয়ে বেশ অনিয়ম করতো।

সকালের খাবার একসাথে একদম দুপুরে খেত। আমি ভাবলাম এজন্য প্রেশার লো হয়ে যেতে পারে। আমি বালতিতে করে পানি এনে মাথায় পানি দিলাম। তেল দিলাম। হাতে পায়ে তেল পানি ঘষলাম। কিন্তু ওর খারাপ লাগা বাড়তেছিলোই। এর মধ্যে আমার ফোন বালতির পানিতে পড়ে বন্ধ হয়ে গেলো। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম তোমার কেমন লাগে আমাকে বলো, আমি সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা করতেছি। ও কিছু বলতেছে না।

একটু শরবত দিলাম কিন্তু খেতে পারলো না। পরে দৌড়ে বাসার পাশে ক্লিনিক থেকে ডাক্তার আনতে গেলাম। তারা না এসে বললো জলদি হাসপাতালে নিয়ে যান। আমি আবার এসে ওকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটলাম। যাত্রাবাড়ী একটা হাসপাতালে ডাক্তার পেলাম না, সাথে সাথে এম্বুলেন্সে করে আসগর আলীতে নিয়ে আসলাম। ওখানে ইমারজেন্সিতে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করলো।

আমার ফোন বন্ধ থাকার কারনে কাউকে জানাতেও পারতেছিলাম না। পরে হাসপাতাল থেকে ফোন নিয়ে ওর ডিপার্ট্মেন্টের এক বড় ভাইকে ফোন দিয়ে ওর ফ্রেন্ডদের খবর দিতে বলি। সে সানীকে পাঠায়। সানীকে হাসপাতাল থেকে কোনো ফোন দেয়া হয় নাই।

উল্লেখ্য অংকন হাসপাতালে যাওয়ার সাথে সাথেই চিকিৎসা শুরু হয়। কিন্তু বিপত্তি বাধে ওকে আইসিইউ তে ঢোকানো নিয়ে। রোগী ভর্তি না হলে আইসিইউতে ঢোকানো নাকি যাবে না। আমার কাছে ওই মুহূর্তে মানিব্যাগ নেই, ফোন নেই। তাই টাকাও ম্যানেজ করতে পারতেছিলাম না। কোনো পরিচয় সম্পর্কিত কিছুর জন্য ওরা ভর্তি নিচ্ছিলো না এটা একদম ভুল কথা। এরপরে ওর মা ভাই, কাকা, এরপরে ওর বাবা আসে।

৯. অংকন আমার বাসায় আসে সকাল প্রায় ১১.৩০ এ। (ও আমার বাসার নিচে এসে হোয়াটসএপ ম্যাসেজ দিয়েছিলো। সেখানেই এক্সাক্ট সময় দেয়া)। আমি ওকে হাসপাতালে ১২.৩০ টার মধ্যেই নিয়ে যাই। সামান্য একটু শরবতে কিছু খেয়ে থাকলে এই সময়ের মধ্যে রোগীর অবস্থা এত খারাপ হয় না। দ্বিতীয়ত শরবতে কিছু থেকে থাকলে তো স্বভাবতই ওকে সরাসরি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা। বাসার পাশের ক্লিনিক থেকে ডাক্তার বাসায় এসে নিশ্চয়ই শরবতের বিষক্রিয়া দূর করতে পারবে না। তৃতীয়ত, হাসপাতালে ভর্তির পর অঙ্কনের ব্যাগ থেকে ৫০০ এমএল এর পানির বোতলে কিছু একটা বেগুনি রঙের পদার্থ মিশ্রিত পাওয়া যায়। ওটা কাউকে জোর করে খাওয়াতে গেলেও উইথ আউট ফিজিকাল হার্ট, এললিস্ট মুখে, ঠোটে আঘাত না লাগিয়ে খাওয়ানো সম্ভব না। মেডিকেল রিপোর্টে বা ডাক্তারের ভাষ্যে এর ঠোটে, মুখে বা দেহের কোথাও কোনো আঘাত নেই। সবকিছু একদম স্বাভাবিক। ডাক্তার বলেছিলো এর পয়জন ছিলো ওভারডোজ। মানে অতিরিক্ত মাত্রায় খাওয়া হয়েছিলো। কোনো আঘাত না করে বা সামান্য শরবতের সাথে মিশিয়ে ওভারডোজ কিভাবে দেয়া যেতে পারে আমার জানা নাই। আমি একজন আইন বিষয়ে পোস্ট গ্রাজুয়েট করা ছাত্র। জেনে বুঝে নিজের বাসায় কাউকে কিছু খাওয়ানোর মত চিন্তা আমি করবো?

উল্লেখ্য বাসায় আসার কথা ও নিজে থেকেই আমাকে বলছে। ওকে আমি আসতে বলি নাই কিংবা বাধ্য করি নাই। সেটারও প্রমান আছে।

১০. আমার অন্য মেয়ের সাথে প্রেম ছিলো কিনা! সানীর স্টাটাসকে প্রাধান্য দিলে এটা ভাবার তো কোনো অবকাশই থাকে না। কারন ওর ভাষ্যমতে আমি অংকনকে জোর করে ধরে রাখছি, বিয়ে করছি। এসব করলে অন্য মেয়ের সাথে প্রেম কিভাবে করে! এর বাইরে অন্য মেয়ের সাথে প্রেম তো দূরের কথা, প্রেমের ধারেকাছে কিছু একটাও কেউ প্রমান করতে পারবে না। কিংবা করার প্রশ্নই আসে না।

১১. মূল কথা আমার ধারণাতেও ছিলো না এই ধরণের কোনো ঘটনা ঘটে যেতে পারে। এটা সত্য গত একমাস ও খুবই ডিপ্রেশনে পড়ে গেছিলো, আর আমি ওকে প্রতিনিয়ত স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতাম। আবার সামান্য কিছু নিয়ে মনোমালিন্য হলেই ওটা ওকে অনেক বেশি আঘাত করতো। মানসিক আঘাত একেকজনের কাছে একেক রকম। কেউ অল্প আঘাতেই ভেঙে পড়ে, আবার কেউ অনেক বড় আঘাতেও টিকে থাকে। বাইরে থেকে সবসময় ভেতরের প্রকৃত অবস্থা তো বোঝা যায় না। এমনও তো হয়েছে যে মা পাখি ড্রেস কিনে দেয় নাই বলে মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। তাই বলে কি ওই মা ঘাতক? ওই মা হত্যাকারী? বাহ্যিক আঘাতের মাত্রা আমরা বুঝি। কিন্তু ভেতরের আঘাতে কার কতটুকু ক্ষত হলো সেটা তো বুঝি না আমরা। তাই ডেলিবারেট বা সরাসরি জড়িত না থাকলে শুরুতেই জাজমেন্টাল হয়ে একপেশে ভাবে কাউকে দোষারোপ করা কি ঠিক?

ওর বিভিন্ন কর্মকান্ডে আমিও মানসিক ডিপ্রেশনে ছিলাম বেশ কিছুদিন। তখন যদি আমি ওর মতো কিছু করে বসতাম তখন সব দোষারোপ একপেশেভাবে ওর ঘাড়ে পড়তো না? কেউ এই ধরণের সুইসাইডাল কিছু করলেই আমরা কেন প্রকৃত সত্যটা না জেনেই বিপরীত পাশের মানুষটাকেও সেই একই দিকে ঠেলে দিই? সাধারণ মানুষদের সাথে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের বোধহত জায়গা থেকে তো অনেক পার্থক্য থাকা উচিত। চিলে কান নিয়ে গেছে শুনলেই কানে হাত না দিয়েই চিলকে দোষারোপ করা কতখানি যুক্তিযুক্ত?

বিয়ে আমরা একদম পারস্পরিক সম্মতিতে করেছি। কিন্তু ওর বাবার ভয়, ওর ফ্যামিলিকে তার কমিনিউনিটি কিভাবে দেখবে এসব নিয়ে অনেক ভাবনায় পড়ে গিয়েছিলো ও। চলে আসতে চাইতো আমার কাছে। বাসায় থাকলে ওর বাবা মায়ের মুখোমুখি হতে হতো এটা ওর ভালো লাগতো না। কিন্তু ওর মাস্টার্স শেষ হওয়া পর্যন্ত বা বাসা থেকে চূড়ান্তভাবে বিয়ে ঠিক না হওয়া পর্যন্ত আমি ওকে অপেক্ষা করতে বলেছিলাম। এর বাইরে কিছু বিষয় নিয়ে আমার সাথে ইনজাস্টিস করেছিলো ও। সেটা নিয়েও অপরাধবোধ কাজ করতো ওর মধ্যে। তারওপর ঘটনার আগের দিন ওভাবে ওকে আসতে মানা করায় অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছিলো ও। কিন্তু এসবের ফলাফল এইদিকে গড়াবে সেটা ঘূণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি আমি।

আমার কোনো গিলটি মাইন্ড ছিলো না। ওকে অন্ধের মত ভালোবাসতাম আমি। যার বহু প্রমান আমি দিতে পারবো। কিন্তু নানা মতের অমিলের কারনে অনেক সময় ঝগড়া হতো, সেটা সব সম্পর্কেই হয়। আবার ঠিকও হয়ে যায়। কিন্তু এসবের চুড়ান্ত পরিণতি এমন হবে আমার ভাবনাতেও ছিলো না! আংকেল মানে ওর বাবা খুবই স্ট্রিক্ট মানুষ। প্রথম দিনই অনেক হুমকি ধামকি দিয়েছেন অংকনের কিছু হলে তিনি কাউকে ছাড়বেন না। কিন্তু আমি একচুলও ভীত না হয়ে সর্বক্ষণ তাদের পাশে থেকেছি, তাদের সাথে যোগাযোগ রেখেছি। কেননা আমার নিজের কাছে আমি একদম ফ্রেশ। আমার বিশ্বাস ছিলো যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে আমি নির্দোষ প্রমাণ করতে পারবো।

আপনারা প্লিজ জাজমেন্টাল হয়েন না। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে একজনকে অন্যায়ভাবে দোষী করলে সে নিজেও একই পরিস্তিতিতে পড়বে, প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে। তখন সেও অন্যের ভুল জাজমেন্টের শিকার হবে। তাই মাথা ঠান্ডা করে ভাবেন। আমাকে যারা চেনেন, জানেন তারা এটলিস্ট জানেন আমি কখনো কারো সাথে জীবনে মারামারি পর্যন্ত করি নাই। সেখানে ভালোবাসার মানুষটার সাথে এমন কিছু হোক সেটা আমি দুঃস্বপ্লেও ভাবতে পারি না। এটা অনেকগুলো ছোট ছোট ঘটনার আফটার ম্যাথ, যেটার ইলিমেন্ট আমি, ওর পরিবার, বন্ধু সবাই।

আমাকে যারা অপছন্দ করেন তারা এখনের জন্য এটলিস্ট ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে কাঁদা ছোড়া বন্ধ করেন প্লিজ। এটা দুইটা মানুষের জীবন মরণের প্রশ্ন। কোনো তামাশা না। আপনি আজকে সুযোগ নিতে চাইলে, আল্লাহ এমন না করুক কালকে এমন পরিস্থিতিতে অন্যরা আপনার সুযোগ নিবে। তাই দয়া করে কোনো দুর্বলতার সুযোগ নিয়েন না। অঙ্কনের জন্য ওর মা বাবা যতখানি ভেঙে পড়েছে, আমার অবস্থা তার চেয়ে কোনো অংশে ভালো না। গত ১৬/১৭ টা দিন আমার কাছে প্রতিটা মুহূর্ত জাহান্নাম মনে হয়েছে। এটাকে আরও জাহান্নাম বানায়েন না।

ওর পরিবার আমার সাথে এই বিষয়টা নিয়ে অন্যদের দিয়েও খোঁজখবর নিয়েছে। প্রতিনিয়ত আমার সাথে কথা বলেছে। ওর দিদা আমাকে বলেছে একটা জীবন চলে গেছে। ভুল ভাবনার কারনে তারা চায় না আরেকটা পরিবার ধ্বংস হোক। তাদের মেয়ের মৃত্যুর ব্যাপারে সরাসরি আমার ইনভলভমেন্ট পেলে জীবনেও তারা অন্য কিছু নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবতো না। তাই দয়াকরে নতুন করে কাউকে ভিক্টিম বানায়েন না। এটলিস্ট দুইদিক থেকে চিন্তা করেন একটু। একপেশেভাবে ভাইবেন না।

আমার পৃথিবীর পুরোটা জুড়ে অঙ্কনের স্মৃতি। আমি এক মুহূর্তের জন্য এর বাইরে যেতে পারতেছি না। কতখানি ভালোবাসতাম মেয়েটাকে একমাত্র আমি আর আমার আল্লাহ জানে। আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও ওর জীবনটা আল্লাহর কাছে আমি ভিক্ষা চাইছি ১৫ টা দিন। কিন্তু আল্লাহ আমার কথা শুনেন নাই।

হাসপাতালে নেয়ার সময়ে এম্বুলেন্সে ওর মুখ মনে পড়লে আমি নিজেকে এক মুহূর্তের জন্য স্থির রাখতে পারি না। এই ট্রমা আমার সারজীবনে যাবে না। আমার কাছের মানুষরাই কেবল জানে ও আমার কাছে কী ছিলো। কাঁদা ছোড়াছুঁড়ি না করে মেয়েটার জন্য মন থেকে দোয়া কইরেন। ও যেখানে যেভাবেই থাকুক, আল্লাহ ওরে ভালো রাখুক।

পত্রিকা একাত্তর /অশ্রু মল্লিক

ভিডিও দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন

youtube
Patrika71.com
news