প্রতিনিয়ত বেড়ে চলছে দেশে নারী নির্যাতনের মত নিরবিচ্ছিন্ন ঘটনা। প্রতিটি ঘটনা যেন লোমহর্ষক। সরকার কাঠামো পরিবর্তন হয়, নীতিমালা পরিবর্তন হয়। তবুও আড়ালে রয়ে যায় প্রায় ৫০ শতাংশ নির্যাতিত নারী।
প্রতিরোধ প্রচেষ্টায় কিসের অভাব রয়ে গেছে? সুষ্ঠু আইনের ও নীতিমালার,সচেতনতার, অর্থনৈতিক কাঠামোর,পুরুষের মন মানসিকতা নাকি সংস্কৃতিক কঠামোর। আসলে বলতে গেলে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ প্রচেষ্টায় উপরিউক্ত সবগুলোর কিছুনা কিছুর অভাব রয়ে গেছে।
আমরা যতই আধুনিক হই ততই ভিন্ন ভিন্ন এংগেলে নারীদের প্রতি টিসিং করছি। উদাহরণ হিসেবে বলতে গেলে, নোয়াখালিতে গৃহবধূকে নির্যাতন করে ভিডিও ভাইরাল করা। এ কেমন মানসিকতা, নির্যাতনের মত জঘন্য অপরাধ করেও ভিডিও ভাইরাল।
সামন্য কুণ্ঠাবোধ ও হলনা তার। একই ভাবে দেখা যায় রংপুরের একটি ঘটনা গৃহবধূ চামেলি বেগম কে, খুটির সাথে বেঁধে নির্যাতন। উল্লেখ যে, রংপুরের তিনটি আদালতে ১২- ১৭ বছর ধরে বিচারের অপেক্ষায় ঝুলে আছে ধর্ষণের অভিযোগে দায়ের করা প্রায় ১ হাজার মামলা।
বিচার কার্যের এমন দুর্বলতার সুযোগই কি কারন হতে পারে নারী নির্যাতনের। আমাদের দেশে একটা প্রচালিত নিয়ম আছে যে, আমরা যতই সচেতন হইনা কেন, আইনের প্রয়োগ যথাযথ বাস্তবায়ন না হলে কোন কিছুতে প্রতিরোধ বা পরিবর্তন হয়না।
দুই- চারটা সমাজ-উন্নয়ন মূলক কথা বা নীতি কথা শেনার মানুষ হারিয়ে গেছে এবং তার সাথেই বিপর্যয় হয়েছে সুস্থ মানসিকতার। নির্যাতন বলতে আমরা শুধু শারিরীককেই বুঝি না। এটা নির্দেশ করে মানসিক, শারীরিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কৃতির উপরও।
বিশেষজ্ঞদের মতে নারী নির্যাতনের উচ্চ হারের প্রধান কারন অসুস্থ মানসিকতা। করনা কালে দেশে শতকরা ২৩ ভাগ নারী স্বীকার হয়েছেন নারী নির্যাতনের মত তিব্র ঘটনায়। বলা হয় এর বাইরে রয়ে গেছে অনেক নারী যারা আইনের আশ্রয় নেয়নি।
প্রায় ৬ শতাংশ নারী সামাজিক অথবা পারিবারিক সম্মানের কথা ভেবে চেপে যান। ফলে তাদের হিসেবটা বাইরে রয়ে গেছে। আমাদের দেশে নারী নির্যাতনের আরেকটা প্রধান কারন হয়ে আছে patrialism বা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা।
এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা যেন নারী সমাজকে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। পুরুষ যেইভাবে মনে করে সেভাবেই চালিত হয়ে আসছে সমাজ, সংস্কৃতি ও পরিবার ইত্যাদি। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও নারীরা যেন কথা বলার স্পেস ই-পায় না।
খুব কম সংখ্যক দেখা যায় নারীদেরকে রাজনৈতিক অবদানে। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক সংগঠনেও নারীদের কোন ভুমিকা দেখা যাচ্ছে না। আর নারীরাও প্রত্যয়ের বলায় দিয়ে টানছেন এমন উক্তিকে যেমনঃ "জীবন যেখানে যেমন"।
না কখনোই এমন প্রত্যয়কে প্রাধান্য দেওয়া যাবে না। আপনাকে " না "বলতে শিখতে হবে। সরকার নারী নির্যাতনের স্বিকার ও নারীদের সহায়তা করতে নানাধরণের পদক্ষেপ নিয়েছে। চালু করা হয়েছে নারীদের জন্য জাতীয় হেল্পলাইন ১০৯ নম্বর দিয়ে।
সরকারের ৫৪ টিরও বেশি সেবা পাওয়া যায় এই হেল্পলাইন থেকে। তাহলে কেনো আপনি বা আমি নির্যাতনের স্বীকার হয়ে আড়ালে থাকব। আড়ালে থাকা মানেই পুরুষ সমাজকে নির্যাতনের মত জঘন্য কাজ করার জন্য একধাপ এগিয়ে দেওয়া।
আর নারী সমাজের উন্নয়নের একটি ধাপে ছোবল দেওয়া। আপনার সাথে ঘটে যাওয়া একটি কাঙ্ক্ষিত সুষ্ঠ বিচার কার্যক্রম ই এগিয়ে নিতে পারবে নারী সমাজকে। রাষ্ট্রীয়ভাবে বা ব্যক্তিগতভাবে সমাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে আমাদের কিছু সুষ্ঠু কার্যক্রম গ্রহন করা দরকার যা নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করবে নারীকে।
প্রথমত, রাষ্ট্রীয়ভাবে নারীদের নির্যাতনের স্বীকার থেকে রক্ষা করার জন্য আইনি কার্যক্রমকে আরও সচল করতে হবে। কেন ঝুলে থাকবে ১৫- ১৭ বছর ধরে একই মামলা। বিচার কর্যক্রমকে আরও দ্রুততম করতে হবে কোন পক্ষপাতিত্ব ছাড়া। একটি সুষ্ঠু বিচারই পারে নারী নির্যাতন বন্ধ করতে।
এতে করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সহজেই নীতিনৈতিকতা ও অসুস্থ মানসিকতা পরিবর্তন করতে বাধ্য হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিচার কার্যক্রমে চারটি কারনই মূলত নারী নির্যাতন প্রতিরোধ কার্যক্রমে প্রধান বাঁধা হয়ে আসছে।
১/ মামলার সংখ্যাধিক্য ও বিচারক সংকট।
২/ মামলার বাদী ও সাক্ষিরা সময় মত সাক্ষী দিতে আসেনা।
৩/ মামলার সাক্ষী দের আদালতে হাজির করতে পুলিশের ব্যার্থতার পরিচয় দেওয়া।
৪/ আসামিপক্ষ নানান অজুহাতে মামলার বিচার শেষ করতে বিলম্ব করা।
এসব প্রতিবন্ধকতার সমাধান কোথায় খুজতে হবে। দ্বিতীয়ত হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যাবস্থা। জাতীয় পর্যায়ের জরিপ ( ভায়োলেন্স আ্যাগেইনষ্ট উইমেন সার্ভে) এতে উঠে এসেছে ভয়ংকর সব তথ্য। তারা মনে করত নারী গৃহেই নিরাপদ। কিন্তু জরিপের তথ্য মতে, নারী গৃহেই অনিরাপদ। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ঘরের ভিতরে স্বামী ও অন্য আপনজনদের কাছেই নারী অনেক বেশি নির্যাতনের ঝুঁকির মধ্য থাকে এবং স্বীকার ও হয়।
জরিপে ৭০ শতাংশ নারী জানিয়েছে তারা আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল।৷ দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে নারীকে ভোগের সামগ্রী নয় মানুষ হিসেবে ভাবার পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন করতেই হবে। নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি শিক্ষিত, বিনয়ী এবং দায়িত্বশীল জনগোষ্ঠী গড়ে তুলতে কার্যকরী মননিবেশ করতে হবে।
পত্রিকাএকাত্তর /নাসরুল্লাহ ইসলাম