ভাষা আন্দোলনে চিকনমাটির দুই কৃতি সন্তান, বিনম্র শ্রদ্ধা

উপজেলা প্রতিনিধি, ডোমার

উপজেলা প্রতিনিধি, ডোমার

২০ ফেব্রুয়ারী, ২০২২, ২ years আগে

ভাষা আন্দোলনে চিকনমাটির দুই কৃতি সন্তান, বিনম্র শ্রদ্ধা

​১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সারাদেশ যখন উত্তাল, তখন ডোমার উপজেলার ঐতিহ্যবাহী দুই কৃতি সন্তান ভাষা আন্দোলনের অগ্র সৈনিক হিসেবে মায়ের ভাষা ‘বাংলা’ কে রাষ্ট্রভাষা করতে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। শহিদ সালাম, বরকত, রফিক, শাফিউর, জব্বার সহ অগণিত বাঙালি ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলা ভাষা, সারাবিশ্বে বিরল। পৃথিবীর কোনো জাতিগোষ্ঠী তাদের ভাষার দাবীতে রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করে নি।

ভাষা আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখা ডোমার উপজেলার ঐতিহ্যবাহী চিকনমাটির দুইজন হলেন—ভাষা সৈনিক গোলাম রব্বানী বুলবুল ও ভাষা সৈনিক এ্যাডভোকেট আনোয়ার হোসেন।

বায়ান্ন’র ২১শে ফেব্রুয়ারী ঢাকায় ছাত্র-জনতার উপর পাকিস্তান পুলিশের গুলিতে ছাত্র হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে উত্তরবঙ্গে গড়ে ওঠে চরম আন্দোলন। সারাদেশে ভাষার দাবীতে আন্দোলন, সংগ্রাম গড়ে উঠলে এক পর্যায়ে পাকিস্তান তাদের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ‘বাংলা’ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। রক্তে কেনা মায়ের মুখের ভাষা বাংলার সম্মানার্থে আজ সারাবিশ্বে পালন হয় ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও শহিদ দিবস’।

ভাষা সৈনিক গোলাম রব্বানী বুলবুল (২২ জানুয়ারী, ১৯৩৫—১৯ জুলাই, ১৯৯৮) : তেভাগা আন্দোলনের সংগ্রামী নেতা গোলাম আজিজ ও জয়নব নাহারের কোল আলো করে জন্ম নেয় তাদের প্রথম সন্তান গোলাম রব্বানী। নানী আদর করে নাম রাখেন বুলবুল। ১৯৪৫ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী শেষে ডোমার বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক পাশ করে সে বছরই উত্তরবঙ্গের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ কারমাইকেল কলেজ, রংপুরে আই.এস.সি. তে ভর্তি হন। ১৯৫২ সালে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” দাবীতে সারা দেশ যখন উত্তাল, উত্তরবঙ্গের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কারমাইকেল কলেজেও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সোচ্চার।

গোলাম রব্বানী বুলবুল কারমাইকেল কলেজের ভাষা আন্দোলনে ছিলেন অগ্র সৈনিক। ১৯৫২ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারী রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শহীদ আবুল বরকতের গুলিবিদ্ধ হওয়ার রক্তাক্ত স্থানটিতে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। রংপুরের ছাত্ররাও শহীদ মিনার নির্মাণের তাগিদ অনুভব করে। ১৯৫৬ সালে রংপুরে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতের বেলা ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের যৌথ উদ্যোগে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরী ময়দানে লাইব্রেরি ভবনের মাঝখানের হলরুমের ঠিক সম্মুখ ভাগে ছোট আকারের শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। ছাত্ররা নিজেরাই ইট, সিমেন্ট, বালি জোগাড় করে মিনারটি নির্মাণ করেন। এই শহীদ মিনার নির্মাণ কাজে ছাত্রনেতা গোলাম রব্বানী বুলবুল অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। পরদিন ভোর বেলা এই শহীদ মিনারেই রংপুরের আাপামর ছাত্র জনতা অমর শহীদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করে। অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শপথ গ্রহণ করে।

১৯৫৩ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের রংপুর জেলা কমিটি গঠিত হলে গোলাম রব্বানী বুলবুল সহ-সম্পাদক নির্বাচিত হন। সভাপতি ছিলেন সুফী মোতাহার হোসেন, সহ-সভাপতি মুকসুদ হোসেন, সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী (বুলবুল)।

তার পরিবার ছিল ডোমারে একটি পরিচিত সাংস্কৃতিক পরিবার। গোলাম রব্বানী বুলবুল ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। তিনি ডোমারের ঐতিহ্যবাহী ‘শহীদ ধীরাজ-মিজান স্মৃতি পাঠাগার ও মিলনায়তন’ এর আজীবন সদস্য ছিলেন। শেষ জীবনে তিনি হাঁপানি (অ্যাজমা) ও ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হন। ১৯৮৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের আমন্ত্রণে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে তিনি সেখানে যান এবং তিন মাস চিকিৎসা শেষে সুস্থ্য হয়ে ফিরে আসে। সেখানে অবস্থান কালে সেখানকার সমাজ ব্যবস্থা, মানুষের জীবনাচরণ বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।

ডোমারের কৃতি সন্তান, মানবকল্যাণে আমৃত্যু ব্রতী, সমাজ বদলের লড়াকু সৈনিক, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা গোলাম রব্বানী বুলবুল ১৯৯৮ সালের ১৯শে জুলাই চিকিৎসাধীন অবস্থায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ২০ জুলাই, ১৯৯৮ তারিখে ডোমার কেন্দ্রীয় ঈদগাহ ও কবরস্থানে (তৎকালীন চিকনমাটি নতুন ঈদগাহ ও কবরস্থান) ডোমারবাসীর অন্তিম শ্রদ্ধায় সমাহিত করা হয় বিপ্লবের এই অগ্রপথিককে।

ভাষা সৈনিক এ্যাডভোকেট আনোয়ার হোসেন : বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা এ্যাডভোকেট আনোয়ার হোসেন পঞ্চাশ দশকে উত্তরবঙ্গের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ কারমাইকেল কলেজ, রংপুর’র ছাত্র হিসেবে ভাষা আন্দোলনে কৃতিত্বপূর্ণ নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন। তিনি নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার ঐতিহ্যবাহী চিকনমাটি গ্রামের মধ্য ধনিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আবুল হোসেন (তৎকালীন স্টেশন মাস্টার)।

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবীতে যেমন আন্দোলন করেছিলেন, ঠিক তেমনিভাবে দেশমাতৃকার টানে স্বাধীনতা আন্দোলনেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। রাজনৈতিক জীবনে নীলফামারী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ছিলেন। ২০০৪ সালের ১১ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

তার এক পুত্র ঢাকার সরকারী তিতুমীর কলেজের অধ্যক্ষ এবং আরেক পুত্র আরিফ হোসেন মুন বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক। বর্তমানে সাবেক এই ফুটবলার বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) এর সদস্য, নীলফামারী জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ও নীলফামারী পৌর আওয়ামী লীগের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

মহান ভাষা আন্দোলনে উত্তর জনপদে নেতৃত্বদানকারী ডোমারের এই দুই কৃতি সন্তানের স্মৃতি রক্ষার্থে দুটি সড়কের নামফলক ছাড়া আর তেমন কিছু চোখে পড়ার মতো। ডোমার রেলওয়ে স্টেশনের পূর্বদিক থেকে চিকনমাটি মোড় অব্ধি ‘ভাষা সৈনিক এ্যাডভোকেট আনোয়ার হোসেন সড়ক’ এবং ডোমার বাজার থেকে চিলাহাটি রোডের শালকী ব্রিজ পর্যন্ত ‘ভাষা সৈনিক গোলাম রব্বানী বুলবুল সড়ক’ নামকরণ করা হয়। তবে নেই কোনো স্মৃতিফলক কিংবা ম্যুরাল।

মহান শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে কীর্তিমান দুই নেতার প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

পত্রিকা একাত্তর/ আজমির রহমান রিশাদ​

ভিডিও দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন

youtube
Patrika71.com
news