বাঘায় এতিমখানা ব্যবসায় পরিচালকের 'আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ'

নিজস্ব প্রতিনিধি

নিজস্ব প্রতিনিধি

১৪ জুলাই, ২০২২, ১ year আগে

বাঘায় এতিমখানা ব্যবসায় পরিচালকের 'আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ'

গত পর্বে বাঘা উপজেলার সরেরহাট এতিমখানায় চলমান দূর্নীতিগুলোর চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এ পর্বে এসব দূর্নীতির গোড়ার নানা তথ্য তুলে ধরা হবে। সেইসাথে এতিমখানা পরিচালকের অঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার পেছনে বিদ্যমান রহস্যের উন্মোচন করা হবে।

ধারাবাহিক প্রতিবেদনের ২য় পর্ব আজ-

রাজশাহীর বাঘা উপজেলার সরেরহাট এতিমখানায় চলমান দূর্নীতির চিত্র দিন দিন যেন লাগামহীন হয়ে উঠছে। সকলের সামনেই এসব দূর্নীতি সংঘটিত হওয়ার পরেও কোন এক আজানা রহস্যে নিশ্চুপ সবাই। বাঘার এই এতিমখানার বিরুদ্ধে দূর্নীতির অভিযোগ পেয়ে অনুসন্ধানে গেলে বেরিয়ে আসে একের পর এক দূর্নীতির নানা চিত্র।

বাইরে থেকে লোক দেখানো সাজসজ্জা থাকলেও ভেতরের চিত্র সম্পূর্ন আলাদা। এ যেন মানবতার মোড়কে 'এতিমখানা বাণিজ্য'। শুরুটা হয় প্রায় তিন যুগ আগে। নিজের চাকরি ছেড়ে এতিমখানা খোলার কথা ভাবেন এক পল্লী চিকিৎসক। যেই ভাবা সেই কাজ। অনুদানের জমিতে এতিমখানার প্রতিষ্ঠাও করে ফেলেন ডাক্তার সমেশ নামের ওই পল্লী চিকিৎসক।

কিন্তু খরচ যোগাবে কে? এবার জমি বিক্রি করে, বিভিন্ন অনুদান এনে শেষ চেষ্টাটি করলেন তিনি। মানুষের সহানুভূতি পেতে দেশের প্রথম সারির এক গণমাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্বের কথা জানান দেন তিনি। ব্যাস আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। একদিনেই মানবতার ফেরিওয়ালা বনে যান তিনি, মানুষের সহানুভূতির সাথে সাথে পেতে থাকেন দেশি-বিদেশি নানা অনুদান।

হালে পানি পেয়ে দিন দিন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হতে থাকে তার। ভূমিহীন পল্লি চিকিৎসক হতে থাকেন জমির মালিক। এলাকার মানুষের দৃষ্টি এড়াতে অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে নিজের সম্পত্তি বাড়াতে থাকেন তিনি। কিন্তু বিধি বাম, অল্পদিনেই এলাকাবাসীর নজরে আসে এহেন দূর্নীতি। প্রতিবাদ করলে বিষয়টি মামলা পর্যন্ত গড়ায়।

এ বিষয়ে স্থানীয়দের সাথে কথা বললে তারা জানান, সরেরহাট এতিমখানার বিষয়ে এলাকার সবাই জানে কিন্তু ভয়ে কেউ কিছু বলে না। এতিমখানা কর্তৃপক্ষের সাথে বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের খুব ভাব। দূর্নীতির বিষয়ে কিছু বলতে গেলেই প্রভাবশালীদের রোষানলে পড়তে হয়। তাই বাধ্য হয়েই সবাই চুপ থাকে। স্থানীয়রা আরও জানান, নিজের বিরুদ্ধে হওয়া মামলার খরচ চালাতে গিয়ে সর্বস্ব হারান ডাক্তার সমেশ।

কিন্তু এখন তারা নামে বেনামে প্রচুর জমি ও অর্থবিত্তের মালিক। এতিমখানা খোলার আগেই নিজের পেশা 'পল্লী চিকিৎসক' এর কাজ বন্ধ করে দেন ডাক্তার সমেশ। তার বড় ছেলে ছোটখাটো ব্যবসার সাথে জড়িত থাকলেও ছোট ছেলে এতিমখানার দেখাশোনাতেই নিয়োজিত আছেন বলে তার কোন আয়ও নেই। এই যদি হয় পরিবারবর্গের আয় রোজগারের অবস্থা তাহলে এত অর্থ-বিত্ত অর্জন কিভাবে হয়েছে তা সহজেই অনুমান করা যায়।

এতিমখানা পরিচালকের অর্থ-বিত্তের উৎস খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, প্রতিবছর এতিমখানাটির নামে সরকারি অনুদান আসছে ২৪ লক্ষ টাকা। এছাড়াও রয়েছে বেসরকারি নানা অনুদান। ডাক্তার সমেশের ভাষ্যমতে সরকারি বেসরকারি অনুদান আসছে বছরে প্রায় কোটি টাকার কাছাকাছি। এসব অনুদান এতিমদের পেছনে খরচ করার কথা থাকলেও হচ্ছ তার উল্টোটা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এতিমখানাটিতে ২০০ জন এতিম থাকার কথা থাকলেও সেখানে ৩০ জন এতিমও নেই। এদের মধ্যে অনেকের বয়স আবার ১৮ বছরের বেশি। যারা সরকারি বরাদ্দের আওতাধীন নয়। এরপরেও যারা এতিমখানায় থাকেন তাদের অধিকাংশই আবার এতিমখানা পরিচালকের বড় ছেলের বালিশ কারখানায় কাজ করেন।

এ থেকে সহজেই বুঝা যায়, যাদের নামে সরকারি বেসরকারি অনুদানের টাকা আসছে তারা টাকা পাচ্ছে না, কারন তারা এতিমখানাতেই নেই। তাদের নামে আসা বরাদ্দের টাকা ব্যবহার হচ্ছে ডাক্তার সমেশের জমি আর অর্থ-বিত্ত গড়ার কাজে।

এদিকে প্রশ্ন উঠেছে এতিমখানাটিতে যদি এতিমই না থাকে তাহলে সরকারি বেসরকারি অনুদান আসে কিভাবে? সমাজসেবা অফিস থেকে কি খোঁজ নেয়া হয়না?- এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে পাওয়া যায় নতুন এক 'আয়নাবাজি'র সন্ধান। এলাকাবাসী জানান, এতিমখানা পরিদর্শনে এলে আগে থেকে জানিয়ে রাখতে বলেন এতিমখানা কতৃপক্ষ।

পরিদর্শনের আগে আশেপাশের মাদ্রাসা থেকে ছেলেমেয়েদের ডেকে এনে এতিম সাজানো হয়। আর ঠিক এখানেই সমাজসেবা অফিসের গাফিলতি দৃশ্যমান হয়। তাদের প্রতি এতিমের তালিকার সাথে নাম পরিচয়সহ সকল তথ্য যাচাই করার নির্দেশনা থাকলেও তা তারা করেন না। যার ফলে যে কোন ছোট ছেলে বা মেয়েকেই এতিম সাজানো যায়। আর এভাবেই দিনের পর দিন সরকার আর দাতাদের চোখ ফাঁকি দিচ্ছে সরেরহাট এতিমখানা কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের এক উর্ধতন কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, কোরবানির ঈদের ছুটির পর আমরা সকল অভিযোগের তদন্ত করবো। অভিযোগ সত্য হলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

(বি.দ্রঃ এমন সীমাহীন দূর্নীতির নেপথ্যে কারা আর তাদের সাথে এসব রাজনীতিবিদ এবং সরকারি কর্মকর্তাদের যোগসূত্র কোথায় সে রহস্যের উন্মোচন করা হবে আগামী পর্বে।)

পত্রিকাএকাত্তর /রবিউল ইসলাম

ভিডিও দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন

youtube
Patrika71.com
news