শ্যামনগরে প্লাবিত হচ্ছে নতুন এলাকা, বাড়ছে বিশুদ্ধ পানির সংকট

সাতক্ষীরা জেলা প্রতিনিধি

১৭ জুলাই, ২০২২, ১ year আগে

শ্যামনগরে প্লাবিত হচ্ছে নতুন এলাকা, বাড়ছে বিশুদ্ধ পানির সংকট

গত তিন দিনেও সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালীনি ইউনিয়নের দুর্গাবাটি এলাকার পাউবো’র বেড়িবাঁধের ভাঙ্গন পয়েন্টে বিকল্প রিং বাঁধ নির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। পূর্ণিমার প্রবল জোয়ারের প্রভাবে রিং বাঁধ নির্মাণ করতে না পারায় ভাঙ্গন পয়েন্ট দিয়ে খোলপেটুয়া নদীর পানি লোকালয়ে ঢোকা অব্যাহত রয়েছে।

এতে করে ভাঙ্গন পয়েন্টের বিস্তৃতি বৃদ্ধির পাশাপাশি জোয়ারের পানিতে প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ফলে গত তিন দিনে ওই ইউনিয়নের প্রায় ১৩টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

শনিবার (১৬ জুলাই) দুপুর ও রাতের জোয়ারের পর বুড়িগোয়ালীনি ইউনিয়নের নুতন নুতন চিংড়ি ঘের, কাঁকড়ার প্রজেক্ট, মুরগীর খামার, মিষ্টি পানির পুকুরসহ অসংখ্য কাঁচা পাকা সড়ক পানির নিচে তলিয়ে গেছে। তলিয়ে গেছে প্রায় দুই হাজার একর ফসলী জমিসহ চিংড়ি ঘের। ধ্বসে পড়া শুরু করেছে প্লাবিত এলাকার কাঁচা ঘর-বাড়ি।

কাঁচা পাকা সড়ক ডুবে যাওয়ার পাশাপাশি সম্পুর্ন এলাকা জোয়ারের পানিতে নিমজ্জিত হওয়াড গোটা এলাকাজুড়ে খাবার পানির সংকট তৈরী হয়েছে। বুড়িগোয়ালীনি ইউনিয়ন পরিষদের সামনের সড়ক প্রায় দুই ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। জোয়ারের পানিতে কলবাড়ি, মাদিয়ার অবশিষ্ট অংশ, বুড়িগোয়ালীনি, বিলআটি ও আড়পাঙ্গাশিয়া গ্রামগুলোকে প্লাবিত করার পাশাপাশি ইউনিয়নের গ্রামীণ জনপদের ছোট বড় সংযোগ সড়ক তলিয়ে যাচ্ছে।

নিরাপদ আশ্রয় ও খাবার পানিসহ খাদ্যের খোঁজে বাড়ি-ঘর ছেড়ে বাইরে আসা পানিবন্দী শত শত নারী-পুরুষকে অসহনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। ভাঙ্গন পয়েন্ট দিয়ে জোয়ার-ভাটার সাথে সাথে লোকালয়ে জোয়ারের পানি ওঠানামা অব্যহত থাকায় ভাঙ্গন কবলিত অংশে গভীর খাদের সৃষ্টিসহ ভাঙ্গনের বিস্তৃতি প্রায় সাড়ে পাঁচশ ফুটে পৌঁছেছে।

বুড়িগোয়ালীনি গ্রামের রঘুদাস মাঝি জানান, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার পর্যন্ত তাদের গ্রামে পানি প্রবেশ করেনি। তবে শনিবার দুপুরের জোয়ারের পানিতে বুড়িগোয়ালীনিসহ আশপাশের আরও ৪ গ্রামে পানি ঢুকেছে। সমগ্র এলাকা লবণ পানিতে ডুবে যাওয়ায় খাবার পানির প্রচন্ড সংকট তৈরী হয়েছে বলেও জানান তিনি।

পানিবন্দী হয়ে পড়া কলবাড়ী গ্রামের সাইফুল ইসলাম জানান, ভাঙ্গনের তৃতীয় দিনে এসে তাদের এলাকার যাবতীয় কাঁকড়ার প্রজেক্ট ও পোল্ট্রি মুরগির খামার ভেসে গেছে। এলাকার কাঁচা পাকা সড়ক পানিতে তলিয়ে থাকায় সমগ্র এলাকা বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত হয়েছে। ভাঙ্গন কবলিত অংশ বাঁধতে দেরী হলে প্রতিদিন নুতন নুতন এলাকা প্লাবিত হবে বলেও তিনি জানান।

টুঙ্গিপাড়া গ্রামের প্রভাষক পরীক্ষিত মন্ডল জানান, তিনদিন ধরে তারা পানিবন্দী অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন। বসতঘরের মধ্যে হাঁটু পানি থাকায় নানাবিধ অসুবিধা সত্তে¡ও যাওয়ার জায়গা না থাকায় বাধ্য হয়ে অনেকে রাতে রাস্তা আর বেড়িবাঁধের উপর কাটিয়ে দিচ্ছে। ভাঙ্গন পয়েন্টে বাঁধার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের এমন দুরাবস্থা কাটবে না বলেও দাবি ওই কলেজ শিক্ষকের।

বৃষ্টির পানি ধরে তৃষ্ণা মেটানোর দাবি করে মাদিয়া গ্রামের মনোয়ারা বেগম জানান, প্রতি বছর একাধিকবার তারা ভাঙ্গনের মুখে পড়ছেন। গত তিন বছরের ভাঙ্গনে সর্বস্ব খোয়ানোর পর এবারের ভাঙ্গনে তাদের আর যাওয়ার জায়গা নেই। পোষ্য গরু ছাগলগুলোকে মুন্সিগঞ্জ ও নওয়াবেঁকী আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, খাবার পানি আর শুকনা খাবারের জন্য দূর-দূরান্তে লোকজন পাঠিয়েও কোন প্রতিকার মিলছে না।

এদিকে, পূর্ণিমার কারণে নদীতে জোয়ারের চাপ বেশী থাকায় সব ধরনের প্রস্তুতি থাকা সত্তে¡ও ভাঙ্গন পয়েন্টের সামনে দিয়ে বিকল্প রিং বাঁধ নির্মাণের কাজ শনিবার তৃতীয় দিনেও শুরু করা যায়নি। পানি উন্নয়নের বোর্ডের সহযোগিতায় স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে স্থানীয় জনসাধারণ দুর্গাবাটি এলাকার ভাঙ্গন পয়েন্টের দুই পাশ দিয়ে বিকল্প রিং বাঁধ নির্মাণের জন্য বাঁশের পাইলিং কাজ শুরু করেছেন। কিন্তু পূর্ণিমার জোয়ারের চাপ কমার জন্য আরো ২/৩দিন অপেক্ষা করতে হবে।

তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ভাঙ্গন পয়েন্টে বিকল্প রিং বাঁধ নির্মাণে যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন হলেও নদীতে জোয়ারের তীব্রতায় কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। প্রতিনিয়ত জোয়ার ভাটার পানি ভাঙ্গন কবলিত অংশ দিয়ে উঠানামা করার কারণে সেখানে ভাঙ্গন প্রায় ৪শ’ ফুট পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানান শ্যামনগর অঞ্চলের সেকশন অফিসার মাসুদ রানা।

বুড়িগোয়ালীনি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম জানান, শনিবার পর্যন্ত তার ইউনিয়নের ৬টি ওয়ার্ডের প্রায় ১৩টি গ্রাম প¬াবিত হওয়ায় অন্তত ৫ হাজার ছোট বড় চিংড়ি ঘেরে ভেসে গেছে। এছাড়া দুই শতাধিক কাঁকড়ার ছোট বড় প্রজেক্ট পানিতে নিমজ্জিত হওয়ার পাশাপাশি ২০/২২টি কাঁচা ঘর ধসে পড়েছে। এসব এলাকার শতাধিক কাঁচা পাকা সড়ক পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি অন্তত ১২ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ইউনিয়নের প্রায় তিন ভাগের দুই ভাগ প্লাতি হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

চেয়ারম্যান আরো বলেন, পাউবো’র সহযোগিতায় আমরা দুর্গাবাটি এলাকার বেড়িবাঁধের ভাঙ্গন পয়েন্টে বিকল্প রিং বাঁেধর কাজ শুরু করেছি। কিন্তু পূর্ণিমার প্রবল জোয়ারের চাপে কাজ করা সম্ভব হচ্ছেনা। তাবে ইতিমধ্যে ভাঙ্গনের দুই পাশ থেকে বাঁশের পাইলিংয়ের কাজ শুরু করা হয়েছে। আগামী ২/৩ দিনের মধ্যে খোলপেটুয়া নদীর জোয়ারের চাপ কমলে মাঝ বরাবর কাজ করা সম্ভব হবে বলে তিনি জানান।

প্রসঙ্গতঃ খোলপেটুয়া নদীর প্রবল জোয়ারের তোড়ে বৃহস্পতিবার (১৪ জুলাই) রাত সাড়ে ১১টার দিকে সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বিভাগ-১ এর আওতাধীন ৫নং পোল্ডারের শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের দূর্গাবাটি এলাকায় বেড়িবাঁধের ১৫০-১৬০ ফুট অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়।

এতে করে ভাঙ্গন পয়েন্ট দিয়ে নদীর পানি ঢুকে প্রথমে ওই ইউনিয়নের চারটি গ্রামের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। শুক্রবার (১৫ জুলাই) সকাল সাড়ে ৯টার দিকে নদীতে ফের জোয়ার শুরু হলে পশ্চিম পোড়াকাটলা, পশ্চিম ও পূর্ব দূর্গাবাটি, আড়পাঙ্গাশিয়া, বুড়িগোয়ালিনীর আংশিকসহ আরো কয়েকটি গ্রামে পানি ঢোকে। শুক্রবার ও শনিবার দিনভর চেষ্টা করে ভাঙ্গন পয়েন্টে বিকল্প রিং বাঁধ নির্মাণ করা সম্ভব না হওয়ায় শনিবার রাত পর্যন্ত বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের মোট ১৩ টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে পড়েছে।

পত্রিকাএকাত্তর /আলফাত হোসেন

ভিডিও দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন

youtube
Patrika71.com
news