র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, র্যাব এলিট ফোর্স হিসেবে আত্মপ্রকাশের সূচনালগ্ন থেকেই বিভিন্ন ধরণের অপরাধ নির্মূলের লক্ষ্যে অত্যন্ত আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করে আসছে। সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ নির্মূল ও মাদকবিরোধী অভিযানের পাশাপাশি খুন, চাঁদাবাজি, চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই চক্রের সাথে জড়িত বিভিন্ন সংঘবদ্ধ ও সক্রিয় সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যদের গ্রেফতার করে সাধারণ জনগণের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে র্যাবের জোরালো তৎপরতা অব্যাহত আছে।
সাম্প্রতিক কালে অনলাইন ভিত্তিক প্রতারণার নতুন-নতুন কৌশল ব্যবহার করে বিভিন্ন কোম্পানী এবং সাধারণ জনগণের কাছ থেকে ডিজিটাল প্রতারণার মাধ্যমে কোটি-কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এক শ্রেণীর প্রতারক চক্র। এসব অর্থ আত্মসাৎকারী ডিজিটাল প্রতারক চক্রের সাথে সম্পৃক্ত অপরাধীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য র্যাব সদা তৎপর।
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথোরিটি (বিআরটিএ) এর প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সার্ভার হ্যাক করে গাড়ির মালিকানা পরিবর্তন, লাইসেন্স নবায়নসহ বিভিন্ন কাজে গ্রাহকদের নিকট অর্থ সংগ্রহ করে গত ১ মাসে প্রতারণা করে কোটি টাকার অধিক সরকারী অর্থ আত্মসাত করেছে একটি প্রতারক চাক্র। এ ঘটনার মূলহোতা কম্পিউটার প্রকৌশলী শাহরিয়ার ও তার অন্যতম সহযোগী আজিমসহ জড়িত ৬ জন কে রাজধানীর কাফরুল, মিরপুর ও গাজীপুর সদর এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে র্যাব-৪।
জানা যায়, গত ১০ মে ‘‘সিএনএস লিমিটেড বাংলাদেশ’’ কোম্পানীর মাসিক লেনদেনের বিবরণীর সাথে মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টের লেনদেন বিবরণী যাচাই-বাচাই শেষে বিআরটিএ এর মোট ৩৮৯টি ট্রানজেকশনে প্রায় ১কোটি ২০ লক্ষ টাকার গড়মিল পরিলক্ষিত হয়।
‘‘সিএনএস লিমিটেড বাংলাদেশ’’ এর ওয়েবসাইটে উক্ত ট্রানজেকশনের পেমেন্ট স্ট্যাটাস পেইড দেখালেও মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টে কোন টাকা জমা হওয়ার প্রেক্ষিতে ‘‘সিএনএস লিমিটেড’’ র্যাব-৪ এর নিকট একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। উক্ত অভিযোগের ভিত্তিতে ‘‘সিএনএস লিমিটেড বাংলাদেশ’’এর ওয়েবসাইট হ্যাক করে অর্থ আত্মসাৎকারীদের আইনের আওতায় আনতে র্যাব-৪ গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে।
এরই ধারাবাহিকতায় গত রাতে র্যাব-৪ এর একটি আভিযানিক দল রাজধানীর মিরপুর, কাফরুল ও গাজীপুর সদর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে “সিএনএস লিঃ বাংলাদেশ” এর ওয়েবসাইট হ্যাক করে সরকারী অর্থ আত্মসাৎকারী চক্রের মূলহোতা কুমিল্লা জেলার শাহরিয়ার ইসলাম (২৬) এবং তার ৫ সহযোগী ঝিনাইদহ জেলার আজীম হোসেন (২৭), নারায়ণগঞ্জের শিমুল ভূঁইয়া (৩২), ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রুবেল মাহমুদ (৩৩), চাঁদপুরের ফয়সাল আহাম্মদ (২৩) ও আনিচুর রহমান (২৩) কে গ্রেফতার করা হয়। উদ্ধার করা হয় প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত সিপিইউ, মোবাইল ফোন, সীমকার্ড, পেনড্রাইভ, বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই ও অন্যান্য সরঞ্জামাদিসহ নগদ ১লক্ষ ৮৯ হাজার ৬শ ৫৯ টাকা।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটক কৃতরা “সিএনএস লিমিটেড বাংলাদেশ” এর ওয়েবসাইট হ্যাক করে প্রতারণামূলক ভাবে বিআরটিএ এর ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করার বিষয়ে তথ্য প্রদান করে।
জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, আটককৃত শাহরিয়ার বিভিন্ন আন-ইথিক্যাল হ্যাকিং ম্যাথড এপ্লাই করে অভিনব কায়দায় “সিএনএস লিমিটেড বাংলাদেশ” ওয়েবসাইট এর পেমেন্ট গেটওয়ে হ্যাক করার মাধ্যমে মানি রিসিপ্ট প্রস্তুত করত। এভাবে তারা সাধারণ জনগণের কাছ থেকে বিভিন্ন গাড়ীর মালিকানা পরিবর্তন, ফিটনেস, ট্যাক্স টোকেন, গাড়ীর রেজিস্ট্রেশন ফি এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক ফিসহ বিভিন্ন কাজে অর্থ সংগ্রহ করত এবং তাদেরকে অর্থ পরিশোধের মানি রিসিপ্ট প্রদান করত যদিও কোন টাকা সরকারী ফান্ডে জমা হত না।
এভাবে তারা প্রতারণার মাধ্যমে সরকারকে বিপুল পরিমান রাজস্ব হতে বঞ্চিত করে। গ্রেফতারকৃতরা গত ১২ এপ্রিল ২০২৩ হতে ১০ মে ২০২৩ তারিখ পর্যন্ত সফটওয়্যার কর্তৃক নকল কোড ব্যবহার করে তৈরিকৃত সর্বমোট ৩৮৯টি মানি রিসিপ্ট প্রস্তুতের মাধ্যমে সরকারী প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা আত্মসাৎসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হ্যাক করেছে বলে জানায়।
এছাড়াও ইতিপূর্বে গত ২০২২ সালের শেষের দিকে তারা ডেসকো কোম্পানীর ওয়েবসাইট হ্যাক করে ট্রানজেকশন আইডি তৈরী করে মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে প্রায় দেড় কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। পরবর্তীতে ডেসকো কর্তৃপক্ষ বিষয়টি বুঝতে পেরে তাদের ওয়েবসাইটের কিছু পরিবর্তন আনলে উক্ত পেমেন্ট আনপেইড উল্লেখ থাকায় গ্রাহকগণ পুনরায় বিল পেমেন্ট করে।
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা প্রতারণার কৌশল সম্পর্কে জানায়, তারা মাঠ পর্যায়ের গ্রাহকদের নিকট হতে বিভিন্ন গাড়ীর মালিকানা পরিবর্তন, ফিটনেস, ট্যাক্স টোকেন, গাড়ীর রেজিস্ট্রেশন ফি এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক ফিসহ বিভিন্ন কাজের জন নির্ধারিত ফি এবং গাড়ীর কাগজপত্র রাজধানীর মিরপুরে ‘মায়ের দোয়া বিজনেস সেন্টার’ ও ‘চাঁদপুর বিজনেস সেন্টার’ কর্তৃক গ্রহণ করে।
পরবর্তীতে গাড়ীর সকল কাগজপত্র স্ক্যান করে হ্যাকিং এর কাজে প্রস্তুতকৃত সফটওয়্যার কর্তৃক নকল কোড ব্যবহার করে তৈরিকৃত মানি রিসিপ্ট এর পিডিএফ কপি ফয়সাল ও আনিচুরের নিকট চ্যানেল মোতাবেক পাঠিয়ে দিত। ফয়সাল ও আনিচুর ওই মানি রিসিপ্ট হাতে পাওয়ার পর সেটা গ্রাহককে বুঝিয়ে দিয়ে ক্যাশ টাকা গ্রহণ করত। এরপর গ্রাহক ঐ মানি রিসিপ্ট দিয়ে বিআরটিএ এর সংশ্লিষ্ট কাজ সম্পাদন করত।
গ্রেফতারকৃত শাহরিয়ার এই প্রতারণা চক্রের মূল হোতা। সে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হয়ে পড়াশোন শেষ না করে রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারি আইটি প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করে। বিভিন্ন আইটি প্রতিষ্ঠানে চাকুরির সময় সে মোবাইল ব্যাংকিং বা অনলাইন ব্যাংকিং এর পেমেন্ট রেসপন্স কোড সম্পর্কে ধারণা পায়। একপর্যায়ে সে নিজেই প্রতারণার উদ্দেশ্যে একটি সফ্টওয়্যার তৈরী করে যার মাধ্যমে অভিনব কায়দায় “সিএনএস লিমিটেড বাংলাদেশ” ওয়েবসাইট এর পেমেন্ট গেটওয়ে হ্যাক করে মানি রিসিপ্ট প্রস্তুত করত।
উক্ত প্রক্রিয়ায় প্রতারণার মাধ্যমে সরকারী অর্থ আত্মসাতের উদ্দেশ্যে আজিমের সাথে যোগাযোগ করে এবং আজিমকে সফটওয়্যার সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রদান করে। সে আজিমকে মাঠ পর্যায়ে গ্রাহকের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ ও ভুয়া মানি রিসিপ্ট প্রস্তুত করার সার্বিক দায়িত্ব প্রদান করে।
গ্রেফতারকৃত আজিম প্রতারণা চক্রের মূলহোতা শাহরিয়ার এর অন্যতম সহযোগী এবং পুরো প্রতারণা প্রক্রিয়ার অপারেশন প্রধান ছিল। সে মূলত প্রস্তুতকৃত সফ্টওয়্যার কর্তৃক নকল কোড ব্যবহার করে মানি রিসিপ্ট তৈরি করত এবং উক্ত মানি রিসিপ্টের পিডিএফ কপি শিমুলকে প্রদান করত।
সে ২০১৬-২০১৭ সালে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করার জন্য ঢাকার একটি কলেজে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে অধ্যায়ণরত ছিল। পরবর্তীতে রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করে। বর্তমানে সে একটি সফটওয়ার কোম্পানীতে কর্মরত। সে চক্রের মূলহোতা শাহরিয়ার এর মাধ্যমে বিআরটিএ ও অনলাইন ব্যাংকিং প্রতারণার সাথে যুক্ত হয়।
গ্রেফতারকৃত শিমুল ২০১৯ সালে ঢাকার একটি কলেজ হতে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে। সে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে প্রবাসি ছিল। গত মার্চ মাসে সে ছুটিতে দেশে এসে আজিমের মাধ্যমে উক্ত প্রতারক চক্রের সাথে যুক্ত হয়। সে মাঠ পর্যায়ে গ্রাহক হতে সংগৃহিত অর্থ ও সফ্টওয়্যারের মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত ভুয়া মানি রিসিপ্ট আজিমের নিকট থেকে সংগ্রহ করে ফয়সালের নিকট প্রেরণের মাধ্যমে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করত।
গ্রেফতারকৃত রুবেল ২০১৪ সালে হোমনার একটি কলেজে এইচ এসসি তে ভর্তি হলেও পড়াশোনা শেষ করেনি। সে গাড়ী ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল। সে শিমুল এর মাধ্যমে উক্ত প্রতারক চক্রের সাথে যুক্ত হয়। সে ফয়সালের নিকট হতে অর্থ সংগ্রহ করে শিমুলের নিকট প্রদান করত।
গ্রেফতারকৃত ফয়সাল ১০ম শ্রেনী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। সে রাজধানীর মিরপুরে মোবাইল ব্যাংকিং এর ব্যবসা করত। সে গ্রেফতারকৃত রুবেল এর মাধ্যমে উক্ত প্রতারণার সাথে যুক্ত হয় এবং মাঠ পর্যায়ে গ্রাহক সংগ্রহের কাজ করত।
গ্রেফতারকৃত আনিছুর ২০১৮ সালে রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ ভর্তি হয়। পড়াশোনার পাশাপাশি সে রাজধানীর মিরপুরে মোবাইল ব্যাংকিং এর ব্যবসা করত। সে তার ফুফাতো ভাই গ্রেফতারকৃত ফয়সাল এর মাধ্যমে উক্ত প্রতারণার সাথে যুক্ত হয়ে মাঠ পর্যায়ে গ্রাহক সংগ্রহের কাজ করত।
গ্রেফতারকৃত আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে।
উল্লেখ্য,“সিএনএস লিমিটেড বাংলাদেশ” একটি সফটওয়্যার ডেভলপমেন্ট কোম্পানি। যারা বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানির সফটওয়্যার ও প্রযুক্তি বিষয়ক কার্যাদি সম্পাদন করে থাকে। উক্ত প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথোরিটি (বিআরটিএ) এর সাথে বিগত ১০-১১ বছর যাবৎ চুক্তি ভিত্তিক বিভিন্ন গাড়ীর মালিকানা পরিবর্তন, ফিটনেস, ট্যাক্স টোকেন, গাড়ীর রেজিস্ট্রেশন ফি এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক ফি বিভিন্ন ব্যাংক এবং অনলাইন ব্যাংকিং এর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে পরবর্তীতে বিআরটিএতে হস্তান্তরের মাধ্যমে যাবতীয় লেন দেনের কার্যাবলী সম্পাদন করত।
পত্রিকা একাত্তর/ রবিউল ইসলাম
আপনার মতামত লিখুন :