বগুড়ার নন্দীগ্রামে ঈদের দিনেও বিধবা মাজেদার পরিবারের ছয় সদস্যের ভাগ্যে জোটেনি কোরবানির পশুর এক টুকরো মাংস।
উপজেলার ভাটরা ইউনিয়নের দমদমা গ্রামে ঈদের দিন বৃহস্পতিবার অর্ধ-শতাধিক পশু কোরবানি হলেও দুস্থদের ভাগ থেকে বিধবার পরিবারকে মাংস দেওয়া হয়নি। এরপরও কারো কাছে মাংসের জন্য হাত পাতেননি মাজেদা। গ্রামের মোড়লদের এমন নিষ্ঠুরতা ও অমানবিক কান্ডের সমালোচনার পাশাপাশি স্থানীয়রা ক্ষোভে ফুঁসছেন।
শনিবার সন্ধ্যায় সরেজমিনে দমদমা দামোপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কুড়ে ঘরের বারান্দায় বসে কাঁদছেন ওই বিধবা। তাকে বাড়িতে একাই পাওয়া যায়, তার ছেলে দিনমজুরির কাজে গেছেন। নাতি-নাতনিকে কোরবানির মাংস খাওয়ানোর জন্য ছেলের বউকে পাঠিয়েছেন বাপের বাড়ি। ঈদের খুশি নেই বিধবার মনে, চোখে মুখে হতাশার ছাপ। ঈদ যেন তাদের জীবন থেকে পালিয়ে গেছে।
মাজেদা বেওয়া বলেন, অভাব-অনটন ও টানা-পোড়নের সংসারে দু’মুঠো ভাতেই কষ্ট। সেখানে কোরবানি বা মাংস কিনে খাওয়া অসাধ্য। ঈদের দিন বিকেলে এবং রাতে ভাতের থালায় মাংস চায় নাতি-নাতনি। সকালে মাংস রান্না করবে বলে নাতি-নাতনিকে শান্তনা দেয় মাজেদা। তার চোখে আবেগের পানি। ঈদের পর দুইদিনেও তাদের খোঁজ নেয়নি কেউ।
স্থানীয় সুত্রে জানা গেছে, ওই এলাকার দামোর পুকুরকে কেন্দ্র করে গ্রামে দুই পক্ষের বিরোধ চলছে। সাবেক ইউপি সদস্য লুৎফর রহমানের সঙ্গে পুকুর সংক্রান্তে বিরোধে জড়িয়েছেন ভাটরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক ইউপি সদস্য মিজানুর রহমান মাসুম, দমদমা জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি আলমগীর হোসেন বাচ্চু, মাহমুদুর রহমান মন্টু, রেজাউল, জিন্নাত আলী, মুকুল হোসেন, হাবির উদ্দিন, তবিবর ও জিয়ারুল। দামোর পুকুরে পানি দেওয়ার জন্য গত একমাসপূর্বে বিধবার ঘরের পাশে পানির সাবমারসিবল পাম্প স্থাপন করেছেন সাবেক ইউপি সদস্য লুৎফর। ওই বিধবার বাড়িতে পানির টিউবওয়েল নেই, তারা জলাশয়ে গোসল করতো এবং অন্যের বাড়ি থেকে খাওয়ার পানি আনতো। যেকারণে সাবমারসিবল তাদেরও উপকারে আসে। সাবমারসিবলের বিদ্যুৎ বিল দেন লুৎফর। কেন তাদের জায়গায় সাবমারসিবল স্থাপন করতে দিলো? এটাই বিধবার পরিবারের অপরাধ!
বিধবার ছেলে জুলহাস প্রামাণিক জুলু, স্থানীয় মোশারফ হোসেন ও শাহীন আলীসহ কয়েকজন ব্যক্তি জানায়, ঈদের আগেরদিন রাতে মসজিদ কমিটির সভাপতি বাচ্চুর নেতৃত্বে গ্রামে বৈঠক বসে। ওইরাতেই মসজিদের সভাপতির লোক জিন্নাত আলী গিয়ে বিধবার ছেলেকে বলে, ‘গ্রামের কোরবানির সরকারি ভাগের মাংস নিতে যাবি না, তালিকাতে তোদের নাম থাকবে না, গেলে মার খাবি।’ একারণে বিধবার পরিবারের কেউ মাংস নিতে যায়নি। ঈদের দিন মসজিদ কমিটির সভাপতির বাড়ির উঠানে রাখা হয় গ্রামের কোরবানির সবগুলো পশুর সরকারি ভাগের মাংস। সেখান থেকে দুস্থদের মাঝে বন্টন করা হয়।
ভাটরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান মাসুম বলেন, গতবারের ঈদে ওই বিধবার পরিবারকে মাংস দেওয়া হয়েছিলো। এবার তারা মাংস নিতে আসেনি শুনেছি। ঈদের আগেরদিন কোনো মিটিংয়ের বিষয়ে জানিনা। মসজিদ কমিটির সভাপতি আলমগীর হোসেন বাচ্চু বলেন, কোরবানির মাংস বন্টনের সময় বিধবার পরিবারের কথা মনে ছিল না।
তবে সাবেক ইউপি সদস্য লুৎফর রহমান বলছেন, বাচ্চু ও মাসুমসহ গ্রামের মোড়লরা ইচ্ছাকৃতভাবে বিধবার পরিবারকে কোরবানির মাংস থেকে বঞ্চিত করেছে। দমদমা দক্ষিণপাড়া মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির মাধ্যমে ৯৭ শতক দামোর পুকরটি ২০১৪ সাল থেকে উপজেলা থেকে প্রত্যেক বছর ডিসিআর কেটে মাছ চাষ করেন লুৎফর। তিনি ওই বিধবার ঘরের পাশে সাবমারসিবল স্থাপন করায় প্রতিপক্ষ গ্রামের মোড়লরা এই কান্ড ঘটিয়েছে।
দমদমা দামোপাড়া এলাকায় ৫শতক জায়গার ওপর ছোট তিনটি কুঁড়ে ঘরে বসবাস করে বিধবা মাজেদার পরিবার। বাঁশের কুঞ্চি আর কাদামাটির দেয়ালের ঘরের ওপরে টিন আর খড়ের ছাউনি। এক ছেলে, ছেলের বউ আর তিন নাতি-নাতনিকে নিয়ে অসহায় জীবন যাপন করেন ওই বিধবা। ধান চাষ করার মতো তাদের কোনো জমিজমা নেই। তার স্বামী আব্দুর রশিদ প্রায় ১০বছরপূর্বে মারা গেছেন। ছেলে দিনমজুরের কাজ করে। তার দুই ছেলে এক মেয়ে।
এ প্রসঙ্গে নন্দীগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিফা নুসরাত এর সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
পত্রিকা একাত্তর/ আব্দুল আহাদ