সকাল থেইকা বিকাল পর্যন্ত কাম কইরা ৩০০ টাকা কামাই করি। সেই কামাই দিয়া নিজে খাই, ছুয়া দুইডাক খাওয়াই-পড়াই। মোর কি আর পিকনিকে যাওয়ার থাকে বাপু, যে চাইলের দাম, মাছ, মাংস, তেলে দাম বাড়ছে। কয়দিন পর ক্যামনে ছুয়াডাক নিয়া চলমু, কি খামু হেয় চিন্তায় বাচিনা, তোমরা কহিচেন পিকনিক করিছি। হামার এইডাই পিকনিক। ডাল-ভাত, শাক-ভাত দিয়া একলগে বসে সবদিন হামরা ভাত খাই। এইডাতে পিকনিকের মজা লয়। পয়সা খরচ কইরা গাড়ীতে চইড়া কি পিকনিক করার সাধ্য হামার আছে।
কথাগুলো ভাত খাইতে খাইতে বলছিলেন জোনাকি রাণী। তাঁর বাড়ী ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বড়বাড়ী ইউনিয়নের আধাদিঘী গ্রামে। রাস্তা নির্মাণ কাজে শ্রমিক হিসেবে ৩০০ মজুরীতে কাজ করেন তিনি। বাড়ীতে দুই মেয়ে রয়েছে, এই রোজগার দিয়ে তিনি নিজে খান এবং অপর দুই সন্তানকে খাওয়ান। স্বামী ছেড়ে গেছেন বেশ কয়েক বছর হলো।
সম্প্রতি বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার আমজানখোর ইউনিয়নের সীমান্ত এলাকায় রাস্তা নির্মাণের কাজ করছিলেন একদল শ্রমিক। দুপুরে কাজের বিরতির পর একসাথে গাছতলা বসে খাওয়ার খাবার সময় ছবি তুলে পিকনিক করছেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
জোনাকি রাণী বলেন, আগে আড়াইশো টাকায় কাম করছিনু। এই টাকাই সংসারটা ভালো চলেছিল। এহন ৩০০ টাকা পাহানেও কোন লাভ হয় না। বেগুনের কেজি ৬০ টাকা, আলুর কেজি ৩৫ টাকা, শাকের আটি ১০ টাকা। মাছ মাংস বাজারে গেলেতো নিজেরে দুর্ভাগা মনে হয়। চারমাস হইলো মাছের বাজারে যায় না।
জোনাকি রাণীর কথা শেষ হতে না হতেই পাশ থেকে ফাতেমা বেগম বলেন, বাবারে কোরবানীর সময় গরুর মাংস খায়ছিলাম। বছর ঘুরে কোরবানী ঈদ না আসলে মনে হয় মাংস খাইতে পারুম না। সারাদিনের টাকা দিলেও আধা কেজি গরুর মাংস কেনা যায় না। এরপরে তেল, লবন, মসলা, পেয়াজতো রান্না করতে লাগেই। এগুলো কিনতে আরেকদিন কাম করা লাগবে।
পাশ থেকে ফজলুল হক প্রশ্ন করে বলেন, তোমরা ফের কে? এইলা জিজ্ঞাসা করেছেন। সাংবাদিক পরিচয় শোনার পর তিনি এগিয়ে এসে জানান, হামার দু:খ কি দেখার কেউ আছে। বাজারের ব্যাগটা হাতে ধরে গেলে বাজারে যেতে ভয় লাগে। ৩ সন্তান রয়েছে, তাদের ভয়ে লুকিয়ে বাজারে ব্যাগ নেয়। যদি দেখে ভালো তরকারি কিনতে বলে, সে সামর্থতো নাই।
জোনাকি, ফাতেমা ও ফজলুল হকের মত তাদের সাথে রাস্তা নির্মাণ কাজ করা প্রায় শতাধিক শ্রমিকের অবস্থা একই। পুরুষেরা ৫০০ টাকায় এবং নারী শ্রমিকরা ৩০০ টাকা মজুরীতে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত রাস্তায় কাজ করেন। এদের অনেকেই অভাবে মাছ-মাংস খেতে পারেন না।
বালিয়াডাঙ্গীর জৈষ্ঠ্য সাংবাদিক মেহমান খানার উদ্যোক্তা হারুন অর রশিদ জানান, প্রতি শুক্রবার নিম্ন আয়ের মানুষদের প্রায় ১ বছরের বেশি সময় সপ্তাহে একদিন মাছ মাংস খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছি। প্রতি শুক্রবার ২০০ মানুষ মেহমান খানায় খেয়ে যান। তাদের সাথে কথা বললেই বোঝা যায়, দ্রব্যমুল্য বৃদ্ধি কারণে কতটা অসহায় এবং খারাপ অবস্থা পার করছে।
ঠিকাদার রফিকুল ইসলাম জানান, বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ৬ শতাধিক নারী-পুরুষ শ্রমিক রাস্তা নির্মাণের কাজ করে। এলাকায় যখন কাজ হয়, তখন কিছুটা শান্তিতে কাজ করতে পারেন এবং উপার্জন থেকে সঞ্চয় করতে পারেন। অন্য এলাকায় গিয়ে যখন কাজ করতে হয়, তখন সেখানে গিয়ে থাকা, ভাড়া ও খাওয়া খরচ বহন করতে গিয়ে সব শেষ হয়ে যায়। বর্তমানে নির্মাণ সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির কারণে ইচ্ছে থাকলেও তাদের পারিশ্রমিক বাড়াতে পারছি না।
পত্রিকা একাত্তর / আনোয়ার হোসেন আকাশ